পদ্মা সেতু প্রকল্পের অধীনে মূল সেতু নির্মাণে প্রথম পর্যায়ের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে সেতু বিভাগ। আজ বুধবার দুপুরে এই দরপত্র আহ্বান করা হয় বলে জানিয়েছেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক সফিকুল ইসলাম। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, ইতিপূর্বে সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এই দরপত্র বিক্রি করা হবে। তাদের দুই মাস সময় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দরপত্র কিনে তা জমা দিতে বলা হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ছয় হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনকালে এ কথা জানান।
এর আগে একই প্রকল্পে সমপরিমাণ টাকা বরাদ্দ রেখে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করে সরকার।
স্বপ্নের প্রকল্প
বিস্তারিত সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয় জাপানের দাতা সংস্থা জাইকা।
২০০৭ সালে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব একনেকে অনুমোদন পায়।
২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি বিস্তারিত নকশা প্রণয়নে পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়া ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দেয়।একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়।
২০১০ সালের ১১ এপ্রিল মূল সেতুর দরপত্র আহ্বান করা হয়।বিশ্বব্যাংকের আপত্তিতে একই বছরের ১১ অক্টোবর পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হয়।
২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে।২৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণসহায়তা অনুমোদন দেওয়া হয়।২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি সই হয়।একই প্রকল্পে ২০১১ সালের ১৮ মে জাইকার সঙ্গে, ২৪ মে আইডিবির সঙ্গে এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি সই হয়।
সংকটের ঘনঘটা
২০১১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আলোচিত ওয়েবসাইট উইকিলিকসে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির একটি তারবার্তা প্রকাশিত হয়।তাতে বলা হয়, ‘আবুল হোসেনের সততার ঘাটতি আছে’।
সেপ্টেম্বরে অর্থমন্ত্রী যান ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে করা একটি তদন্ত প্রতিবেদন ২১ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সেতুর মূল অংশের প্রাক-যোগ্যতা চুক্তির প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিসংক্রান্ত অসংখ্য অভিযোগ পেয়েছে বিশ্বব্যাংক। অভিযোগগুলো মূলত তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও তাঁর মালিকানাধীন কোম্পানি সাকোর শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, যোগাযোগমন্ত্রী ও সাকোর কর্মকর্তারা মিলে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, যাতে মনে হচ্ছে, সাকো হলো পদ্মা সেতু নির্মাণের যেকোনো কাজ পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে এক ধরনের নীরব প্রতিনিধি (সাইলেন্ট এজেন্ট)। কোনো কাজ পেতে হলে বা প্রাক-যোগ্যতায় টিকতে হলে সাকোকে অর্থ দিতে হবে। সাকোর পক্ষ থেকে ঠিকাদারদের ভয়ভীতি দেখানোর কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাকোরই একজন প্রতিনিধি বিশ্বব্যাংককে জানান, পদ্মা সেতুর মূল অংশের জন্য যে চুক্তিমূল্য হবে, তার একটি নির্দিষ্ট অংশ সাকোর জন্য রাখার ব্যাপারে সৈয়দ আবুল হোসেনেরই নির্দেশনা ছিল। বলা হয়, সাকোকে নির্দিষ্ট কমিশন দেওয়া হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবেন সৈয়দ আবুল হোসেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আরেকটি সূত্র থেকে বিশ্বব্যাংক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও অভিযোগের কথা জানতে পারে। সেটি হলো, সাকোর পাশাপাশি অন্য একটি কোম্পানিকেও সাকোর হয়ে কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন আবুল হোসেন। কোম্পানিটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ভয়ভীতিও দেখান মন্ত্রী। সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাকোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ বিশ্বব্যাংক পেয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর ৯ অক্টোবর প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়।১৩ অক্টোবর সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বদলি করা হয়।১৮ অক্টোবর এ বিষয়ে অনুসন্ধান দল গঠন করে দুদক।অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের ঋণসহায়তা স্থগিতের ঘোষণা আসে।
২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি যোগাযোগমন্ত্রীর পদ থেকে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেওয়া হয়।২ ফেব্রুয়ারি মূল সেতুর ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতির তথ্য মেলেনি বলে প্রতিবেদন দেয় দুদক।২০ ফেব্রুয়ারি রমেশ শাহ ও মো. ইসমাইল নামের এসএনসি-লাভালিনের দুই কর্মকর্তা কানাডায় আটক হন।২৬ মার্চ দুর্নীতির অভিযোগে এসএনসি-লাভালিনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়েরে ডুহাইম পদত্যাগ করেন।এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক দ্বিতীয় দফায় দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।সেই প্রতিবেদনে মন্ত্রীসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তাঁরা কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ১০ শতাংশ কমিশন চেয়েছিলেন।এ নিয়ে এখনো তদন্ত করছে দুদক।২ এপ্রিল কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়।২৯ জুন দুর্নীতির বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগে ঋণচুক্তি পুরোপুরি বাতিল করে দেয় বিশ্বব্যাংক।
কানাডায় বিচার
অর্থের অবৈধ লেনদেনের অভিযোগে পদ্মা সেতুর পরামর্শক হতে আগ্রহী কানাডাভিত্তিক প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়েরে ডুহাইমকে গ্রেপ্তার করে সে দেশের পুলিশ। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হয় প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মকর্তা রমেশ শাহ ও মো. ইসমাইলকে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঘুষ দেওয়ার পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। বিচারও শুরু হয়েছে তাঁদের। এতে পদ্মা সেতুর বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচনায় চলে যায়।
সমঝোতার চেষ্টা
এরপর বাংলাদেশের অনুরোধেই সেপ্টেম্বরে শর্ত সাপেক্ষে বিশ্বব্যাংক আবার অর্থায়নে ফিরে আসার ঘোষণা দেয়। মূল শর্ত ছিল—দুর্নীতি নিয়ে দুদক তদন্ত করবে এবং সেই তদন্ত নিরপেক্ষ ও পূর্ণ হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করবে একটি বিশেষজ্ঞ দল। অক্টোবরেই বাংলাদেশে আসে বিশেষজ্ঞ দলটি। দ্বিতীয় দফায় তাঁরা আবার সফর করে ডিসেম্বরে। এরপর ১৭ ডিসেম্বর তিন বিদেশি নাগরিকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এই তালিকায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর নাম ছিল না। কেবল এ কারণেই দুদকের তদন্ত ও মামলা গ্রহণযোগ্য হয়নি বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ দলের কাছে। অসন্তুষ্টির কথা দুদককে জানানোও হয়।
এরপর সরকারের পক্ষ থেকে জানুয়ারির মধ্যে বিশ্বব্যাংকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া থেকে ফিরে বলেন, জানুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না পেলে বিকল্প ব্যবস্থায় পদ্মা সেতু তৈরি হবে। তবে এর পরও অর্থমন্ত্রী শেষ চেষ্টা করেছিলেন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সেতু তৈরির। এ জন্য তিনি ওয়াশিংটনে যাওয়ার কথাও জানান। এ নিয়ে চিঠি দেওয়ার কথাও তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন।
বিশ্বব্যাংককে‘না’
বিশ্বব্যাংক ‘না’ করার আগে বাংলাদেশই ‘না’ করে দেয় বিশ্বব্যাংককে। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে দাতা সংস্থাটিতে চিঠি দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়নের অনুরোধ ফিরিয়ে নেয়। বাংলাদেশের ওই চিঠি আমলে নেওয়ার কথা গত ১ ফেব্রুয়ারি জানিয়ে দেয় বিশ্বব্যাংক। মূল দাতা না থাকায় সহদাতারাও এই প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এর মাধ্যমে শেষ হয় পদ্মা সেতু নিয়ে এক বছর পাঁচ মাস ধরে চলা দীর্ঘ টানাপোড়েন।
অর্থায়নের দেশীয় উদ্যোগ
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। সরকারের আশা ছিল, কাজ শুরু করে মেয়াদের মধ্যেই এর নির্মাণকাজ শেষ করবে। কিন্তু নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ আনলে কাজ স্থগিত হয়ে যায়।
সহজ শর্তে ঋণ না পেয়ে সরকার দেশীয় উদ্যোগে পদ্মা সেতু করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। অর্থেরও বড় জোগান দেওয়া হবে দেশীয় উত্স থেকে। কিছু অংশ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ঋণ নেওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। ফলে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি দায় সৃষ্টিরও আশঙ্কা রয়েছে। তবে সরকার এখনো পুরো পরিকল্পনার কথা জানায়নি। তবে সরকারি সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবে বর্তমান মেয়াদেই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করবে সরকার।
সম্প্রতি পদ্মা সেতু প্রকল্পে ছয় হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করেছে সরকার।
বাজেটে বরাদ্দ
পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ছয় হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনকালে এ কথা জানান।
অর্থমন্ত্রী জানান, ভারতের ২০ কোটি ডলারের (২০০ মিলিয়ন) অনুদানও পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যবহার করবে সরকার। পদ্মা সেতু নির্মাণে দেশের জনগণ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশি অভিবাসীদের সহায়তা চেয়েছেন তিনি। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হলেও এই প্রকল্পে ‘যথাসময়ে’ ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক এবং আরও কিছু উন্নয়ন-সহযোগীর সমর্থন আদায় করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘প্রকল্পের জন্য ভারতের অনুদান ২০০ মিলিয়ন ডলার আমরা ব্যবহার করব। আমি এ-ও আশা করছি যে, এই প্রকল্পের জন্য ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক এবং আরও কতিপয় উন্নয়ন-সহযোগীর সমর্থন আমরা যথাসময়ে আদায় করতে পারব। নিজস্ব অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ যে শুরু করেছি, সেটিই একমাত্র উপায় বলে আমার মনে হয়।’