২০১৯ সালের ২৫ জুলাই। সেদিন মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটে ফেরির অপেক্ষায় প্রায় তিন ঘণ্টা আটকে ছিল স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষকে বহনকারী একটি অ্যাম্বুলেন্স। শেষ পর্যন্ত ঘাটেই মৃত্যু হয় তিতাসের। এরপর প্রায় তিন বছর গড়িয়েছে। কাল শনিবার উদ্বোধন হচ্ছে পদ্মা সেতু। আক্ষেপ করে তিতাসের মামা বিজয় ঘোষ বলেন, সে সময় পদ্মা সেতু থাকলে হয়তো ঘাটে আটকে থাকতে হতো না। ফলে ভাগনেকেও হারাতে হতো না।
নড়াইলের ছেলে তিতাস ঘোষ কালিয়া সরকারি পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত। ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই মোটরসাইকেলে করে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় সে। তিতাসকে নেওয়া হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন স্বজনেরা। পথে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে ভিআইপির অপেক্ষায় ফেরি না ছাড়ায় প্রায় তিন ঘণ্টা আটকে ছিল অ্যাম্বুলেন্সটি।
তিতাসকে বহনকারী ওই অ্যাম্বুলেন্সে ছিলেন মামা বিজয় ঘোষ। সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন তিনি। আজ শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন ঘণ্টা ঘাটে বসে ছিলাম। ফেরির দায়িত্বে থাকা লোকজনকে অনেক অনুনয়-বিনয় করেও কাজ হয়নি। কান্নাকাটি করেছিলাম। পদ্মা সেতু থাকলে হয়তো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারতাম। ভাগনে বেঁচেও যেতে পারত। অন্তত মনের শান্তি পেতাম।’
তিতাসের মৃত্যুর পর থেকে তার মা সোনামণি ঘোষ অধিকাংশ সময় অসুস্থ থাকেন। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। বাবা অনেক বছর আগেই মারা গেছেন। বিজয় বলেন, ‘তিতাসের মৃত্যুর পর থেকে সোনামণি কেমন যেন হয়ে গেছে। শ্মশানে যেখানে তিতাসকে দাহ করা হয়েছিল, সেখানে যখন-তখন চলে যায়।’
তিতাসকে বহনকারী ওই অ্যাম্বুলেন্সে ছিলেন মামা বিজয় ঘোষ। সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন তিনি। আজ শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন ঘণ্টা ঘাটে বসে ছিলাম। ফেরির দায়িত্বে থাকা লোকজনকে অনেক অনুনয়-বিনয় করেও কাজ হয়নি। কান্নাকাটি করেছিলাম। পদ্মা সেতু থাকলে হয়তো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারতাম। ভাগনে বেঁচেও যেতে পারত। অন্তত মনের শান্তি পেতাম।’
তিতাসের মৃত্যুর ঘটনায় ফেরি বিলম্বে ছাড়ার কারণে তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। বিজয় ঘোষ বলেন, ‘সবাই বলেছিল, সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিচার পাইনি।’ এদিকে ওই ঘটনার জন্য তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জহির উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিতাসের পরিবারকে কেন তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। এখন রুল চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় আছে।
ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে যাঁরা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যান, এত দিন তাঁদের পদ্মা পাড়ি দিতে হতো ফেরি, লঞ্চ অথবা স্পিডবোটে। ফেরির অপেক্ষায় কতক্ষণ ঘাটে থাকতে হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। অ্যাম্বুলেন্সও আটকে থাকত। এর জেরে রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারা এসব রোগীর পরিবারের কাছে একটা সেতুর আক্ষেপ ছিল বেশি। আক্ষেপ রয়েছে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের লক্ষ্মীকান্তপুর গ্রামের বাসিন্দা বাবুল হাওলাদারের পরিবারেরও।
গত ২৮ এপ্রিল বিকেলে বুকে তীব্র ব্যথা শুরু হয় বাবুল হাওলাদারের। তাঁকে নিয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন স্বজনেরা। ঘাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই কাহিল হয়ে পড়েন বাবুল। এক সময় অচেতন হয়ে যান।
বাবুল হাওলাদারের ছেলে মাহবুব আলম আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘাটে ফেরি না পেয়ে বাবাকে নিয়ে স্পিডবোটে নদী পার হই। নদী পার হতেই বাবা নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। পথেই বাবার মৃত্যু হয়। পদ্মা সেতু থাকলে হাসপাতালে পৌঁছাতে সময় কম লাগত। এই সেতুর অপেক্ষা দীর্ঘদিনের।’