পদ্মা সেতুর প্রথম সকালে

পদ্মা সেতুতে চলছে যান
ছবি: প্রথম আলো

ভোর ৫টা ৫৫ মিনিট। চানখাঁরপুলের কাছে মেয়র হানিফ উড়ালসেতুতে উঠে মাত্র ২৮ মিনিটে পৌঁছে গেছি মাওয়া এলাকায়। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা আর মাত্র ২ কিলোমিটার। শত শত গাড়ি সামনে, দাঁড়াতে হলো। সর্বসাধারণের জন্য পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার কথা আজ রোববার সকাল ৬টায়। ভাবলাম তাহলে ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যেই সেতু খুলবে, ধীরে ধীরে এগোবে গাড়ির চাকা।

পরিকল্পনা কাল মধ্যরাতের, হঠাৎই। দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতুর উদ্বোধন হয়ে গেল। গাড়ি চালিয়ে যেতেই হয়। কবে? বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই সহকর্মী আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে নানা তথ্য জানার চেষ্টা করেছি। কবে বেশি যানজট থাকতে পারে, কবে কমতে পারে? রাত মনে হলো প্রথম সকালে অর্থাৎ, পদ্মা সেতু সাধারণের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার সময়ই যাওয়া যাক।

ঈদের সময় মহাসড়কের যানজট ঠ্যালার অভিজ্ঞতা তো কম নেই। আবার ভাবলাম, প্রথম দিন ভোরে ভিড় বেশি না–ও থাকতে পারে। সকালেই যাওয়া যাক। পরিবারের বাকি তিনজনকে নিয়ে যাত্রা শুরু। ঢাকা–মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি (এন-৮) পড়লেই একসিলারেটরে পা দেবে যেতে থাকে আপনাআপনি। ধাঁই ধাঁই উঠতে থাকে গতি। দ্রুতই চলে গেলাম মাওয়া এলাকায়।

পদ্মা সেতুতে চলছে যান

টোল প্লাজার দুই কিলোমিটার আগেই থেমে যেতে হলো। ট্রাক, লরি, ট্যাংকার, ছোট-বড় গাড়ি, বাইক—শত শত যানবাহন। কিছুক্ষণ পরপর এগোয়, আবার থেমে যায় যান। গাড়ি থেকে নেমে মাঝেমধ্যেই বোঝার চেষ্টা করি টোল প্লাজা কত দূর। সামনের কনটেইনার বহনকারী ট্রাকের চালক বললেন, ‘টোল প্লাজা থেকে কিছু কিছু গাড়ি ছাড়া হচ্ছে আবার কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখা হচ্ছে। তাঁর ভাষায় “টেস্টিং চলতাছে”।’ থেমে থেকে কারোরই কিন্তু কোনো বিরক্তি নেই। যেন ঈদের ছুটি। সবার মুখেই পদ্মা সেতু পার হওয়ার আগ্রহ আর আনন্দ।

ধীরে ধীরে এগিয়ে টোল প্লাজার কাছাকাছি এলাম। টোল গেট বেশ কটি, দুটি বন্ধ। কিন্তু গাড়ি এলোপাতাড়িভাবে চলছে সাত বা আট লেন বানিয়ে। টোল প্লাজার সামনের রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টাই চোখে পড়ল না। টোল প্লাজায় টোল কর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দেরি হচ্ছে কেন, কিছু কিছু করে গাড়ি ছাড়ছেন?’ ব্যস্ত কর্মী সম্মতিসূচক মুচকি হাসি দিলেন। টোল দেওয়ার পর গেট যখন খুলল, তখন ঘড়িতে সকাল ৭টা ৪০ মিনিট।

মূল সেতুর আগে অ্যাপ্রোচ রোডের শেষ অংশ। পদ্মা সেতুর বিশালত্ব, বিরাট কর্মযজ্ঞের বাস্তবরূপ তখন সামনে। পদ্মা সেতুর নিচতলার রেলপথের নির্মাণকাজও নজর কাড়ার মতো। সড়কে বাঁধা প্রমত্ত পদ্মার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি, ভাবতেই বিস্ময় লাগে। পদ্মা সেতুতে গতি ভালোই পাব, এমন ভাবনা ছিল। কিন্তু মূল সেতুতে উঠে দেখা গেল আমরা সেতুর চার লেনকে সফলভাবে দুই লেনে পরিণত করে ফেলেছি।

মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে চলছে ছবি তোলা

সেতুর রেলিংয়ের পাশের লেনটা সেলফি আর পারিবারিক ছবি তোলার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয় দিন থেকেই প্রচার দেখছি ‘পদ্মা সেতুতে হাঁটাহাঁটি ও ছবি তোলা নিষেধ’। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি ছোট-বড়-মাঝারি গাড়ি মূল সেতুর ওপর উঠে দাঁড়িয়ে পড়ছে, যাত্রীরা নেমে সেতু আর পদ্মা নদীকে নিয়ে ছবি তুলছেন নানা পোজে। রেলিংয়ে ঝুঁকে বিপজ্জনকভাবে গুনছেন পদ্মার ঢেউ। এক শিশুকে দেখা গেল সেতুর রাস্তায় বসে খেলছে, পাশেই তার বাবা-মা।

শত শত বাইকাররা তো আছেনই। থামছেন, সেলফি তুলছেন। অক্সিজেনবাহী একটি ট্যাংকারকেও দেখলাম দাঁড়িয়ে থাকতে। স্থানীয় কোনো এক নেতার অভিনন্দন জানানো এক নৌকাবাহী ট্রাকও আছে দাঁড়িয়ে।

ফলে সাঁই সাঁই করে পদ্মা সেতু পাড়ি দেওয়া হলো না। তবু সোয়া ছয় কিলোমিটার সেতু পাড়ি দিলাম সাত মিনিটে। ফেরি পারাপারের কথা মনে পড়ল। ফেরিতেই আড়াই ঘণ্টা, আর ঘাটে....। পাটিগণিতের কোনো সূত্রই ঘাটে আসা আর ফেরিতে ওঠার সময়ের হিসাব সঠিকভাবে বের করতে পারবে না।

যানবাহন দাঁড় করিয়ে চলছে ছবি তোলা

পদ্মা সেতুর অর্ধেকটা পেরিয়ে জাজিরা প্রান্তের দিকে যখন নামা হচ্ছে, ডান দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল। ঠাসবুনটের সবুজ। পদ্মা সেতুর সবুজ বনায়ন প্রকল্প এটি। চোখ জুড়িয়ে যায়, মন হরণ করে নেয়।

চালু হওয়ার প্রথম প্রহরে পদ্মা সেতু পারাপারই যেহেতু আজকের যাত্রার উদ্দেশ্য, তাই জাজিরা প্রান্তে নেমে প্রথম ইউ টার্নে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরতি পথ। জাজিরার টোল প্লাজা প্রায় খালিই। নারী টোল কর্মী টাকা নিয়ে ভাংতি ফেরত দিলেন, আমরা এগোলাম আবার মাওয়ার দিকে। এ টোল পার হলাম ২৫৬ নম্বর গাড়ি হিসেবে। মাওয়াতে ক্রমিক ছিল ৩২৬।

টোল দিয়ে সেতু পার হতে মাওয়া প্রান্তে জট ছিল সকালের দিকে

এও তো ব্যক্তিগত এক ইতিহাস হতে পারে। ফিরতি পথে সময় লাগল সাড়ে পাঁচ মিনিট। এবারও থামা গাড়ি দেখা গেল। বেশ কটি গাড়ি নিয়ে র‌্যাবের গাড়িবহর কখনো থেমে থাকছে, কখনো ধীরগতিতে সেতু পার হচ্ছিল। হণ্টনরত মানুষের সংখ্যাও কম নয়।

টোলের জ্বালা বড় জ্বালা, মাওয়া যতবার যাই, এটা মর্মে মর্মে টের পাই। মেয়র হানিফ উড়ালসেতুর টোল ৬০ টাকা, তিন দশক আগে তৈরি বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতু ৪০ টাকা, ধলেশ্বরীর জোড়া সেতু ৪০ টাকা আর পদ্মা সেতুর টোল (সেডান গাড়ি) ৭৫০ টাকা। যেতে ৮৯০, ফিরতে ৮৯০—মোট ১ হাজার ৭৮০ টাকা। টোল বিষয়টার আশু সমাধান প্রয়োজন।

পদ্মা সেতুতে হাঁটাহাঁটি ও ছবি তোলা নিষেধ থাকলেও অনেকেই তা মানছেন না

সেতু থেকেই চোখে পড়ে প্রমত্ত পদ্মা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কুবের মাঝিরা আজও এ প্রমত্ত পদ্মায় সারা রাত মাছ ধরেন। কুপির হলুদ আলোর বদলে তাঁদের নৌকায় জ্বলজ্বল করে সাদা এলইডি বাতি। তবে মাছ ধরার সারা রাতের কর্মযজ্ঞ চিরায়ত, যেমন পদ্মার ইলিশের বেলায়।

পদ্মার বুকের ওপর এ আশ্চর্য সেতু সেই কর্মযজ্ঞে নতুন মাত্রা দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওপারে মাছ মেরে পদ্মার ঢেউ ঠেলে নৌকা করে আর হয়তো এপারে আসার প্রয়োজন হবে না। সেতুর ওপার থেকে মাছ নিয়ে কোনো যানবাহনে উঠতে পারলেই ঢাকা এক ঘণ্টারও কম পথ।