শুরুতে যানবাহনের সঙ্গে একই দিন পদ্মা সেতুতে রেল চালুর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু রেললাইন বসানোসহ অন্যান্য কাজ এখনো পিছিয়ে।
পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। এবার সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচলের অপেক্ষা শুরু হলো। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, আগামী বছর জুনে পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চলাচল শুরুর লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। আগামী জুলাই মাসে সেতুর ওপর রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হবে। শুরুতে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত অংশের ট্রেন চালু করা হবে।
পদ্মা সেতু ও এর দুই প্রান্তে রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৮ সালে। প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ২০১৬ সালে। শুরুতে যানবাহনের সঙ্গে একই দিন রেল চালুর পরিকল্পনা ছিল সরকারের। কিন্তু রেললাইন বসানোসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকাজ এখনো পিছিয়ে আছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে সরকারের সেতু বিভাগ। সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করার দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষের। এ লক্ষ্যে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন বসানো এবং স্টেশন ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে আলাদা প্রকল্প নেয় রেলওয়ে। জিটুজি (সরকারি পর্যায়ে) পদ্ধতিতে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে চীন।
এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। প্রকল্পের অগ্রগতি-সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত মে পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৬০ শতাংশ।
মাঝখানে করোনা মহামারিসহ কিছু জটিলতায় আশানুরূপ কাজ এগোয়নি। এখন কাজে গতি বেড়েছে। আগামী বছরের জুনে ঢাকা থেকে ভাঙ্গায় রেল চালানোর লক্ষ্যে কাজ এগিয়ে চলছে।মো. আফজালুর রহমান, প্রকল্প পরিচালক
১৬৯ কিলোমিটার রেলপথের কাজ তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগ ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া। দ্বিতীয় ভাগ মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা। শেষ ভাগে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত অংশ পড়েছে।
শুরুর পরিকল্পনা অনুসারে, মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত অংশ আগে চালুর কথা ছিল। এরপর পর্যায়ক্রমে ঢাকা থেকে মাওয়া এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর অংশের কাজ শেষ হবে। এখন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে।
প্রকল্প সূত্র জানায়, এখন ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেললাইন আগামী বছরের জুনে চালুর লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এই পথের দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার। ভাঙ্গা থেকে ফরিদপুর ও রাজবাড়ীর রেলসংযোগ আগে থেকেই আছে। ফলে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথের কাজ শেষ হলে পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে বিকল্প আরেকটি পথ চালু হয়ে যাবে। এখন ঢাকা থেকে রেলের পশ্চিমাঞ্চলে ট্রেন বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে যায়।
প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা থেকে মাওয়া অংশের কাজ ৬০ শতাংশ শেষ হয়েছে। মাওয়া থেকে ভাঙ্গার কাজ শেষ হয়েছে ৮০ শতাংশ। ৫১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে ভাঙা থেকে যশোর পর্যন্ত। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে ১১ কিলোমিটার রেলপথ বসানো হয়েছে। তবে ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত অংশের কাজ শেষ হতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক মো. আফজালুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মাঝখানে করোনা মহামারিসহ কিছু জটিলতায় আশানুরূপ কাজ এগোয়নি। এখন কাজে গতি বেড়েছে। আগামী বছরের জুনে ঢাকা থেকে ভাঙ্গায় রেল চালানোর লক্ষ্যে কাজ এগিয়ে চলছে।
বর্তমানে দেশের ৪৩টি জেলা রেলযোগাযোগের আওতায় আছে। ২০৩৫ সালে সরকার ৬৪ জেলায় রেলপথ সম্প্রসারণের মহাপরিকল্পনা করেছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঢাকা–যশোর পদ্মা সেতু রেললিংক প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বরিশাল বিভাগের পুরোটাই রেলযোগাযোগের আওতার বাইরে। সরকার এই বিভাগকে রেলের আওতায় আনতে পায়রা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল সংযোগ করতে চায়। ঢাকা–যশোর রেললাইন হলে এই কাজ সহজ হয়ে যাবে।
বর্তমানে খুলনা, যশোরসহ দেশের পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় রেলযোগাযোগ আছে। তবে ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়ে এসব এলাকায় যেতে হয়। বর্তমানে ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত দূরত্ব ৩৮১ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু দিয়ে যে রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে, তাতে ঢাকা থেকে খুলনার দূরত্ব ২১২ কিলোমিটার কমে যাবে। এখন রেলের হিসাবে, আন্তনগর ট্রেনে ঢাকা থেকে খুলনা যেতে সময় লাগে ১১ ঘণ্টা। কিন্তু পদ্মা সেতু হয়ে যে রেললাইন করা হচ্ছে, তাতে উচ্চগতির ট্রেন চালানো সম্ভব। ফলে খুলনা–যশোরে চার ঘণ্টার মধ্যে যাওয়া সম্ভব।
রাজধানীর খুব কাছের হয়েও ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জে রেল যায়নি। মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলাও রেলের বাইরে। পদ্মা সেতু রেললিংক প্রকল্প এসব জেলা ও উপজেলাকে নতুন করে যুক্ত করবে।
বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে ভারী মালবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারে। ওই সেতুতে ট্রেনের গতিও সীমিত। ফলে বেনাপোল স্থলবন্দরের মালামাল ট্রেনে পরিবহন করা যায় না। নতুন রেললাইন হলে দূরত্ব কমবে, ভারী মালবাহী ট্রেন চলাচল বাড়বে। পদ্মা সেতুতে চাইলে দ্বিতল মালবাহী ট্রেন চালু করার সুযোগ রাখা হয়েছে নকশায়। এ নতুন রেলপথ হলে দেশের সার্বিক দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১ শতাংশ বাড়বে বলে রেলের সমীক্ষায় এসেছে।
দোতলা পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করবে যানবাহন। নিচতলা দিয়ে চলবে ট্রেন। মূল সেতু থেকে রেলসংযোগটি উড়ালপথে মাটিতে মিশছে। সেতুতে রেলপথটি নিচতলায় হলেও এটি নামবে সড়কপথের ওপর দিয়ে। রেল ও সড়কপথ যেখানে অতিক্রম করেছে, সেখানকার উচ্চতা নিয়ে জটিলতার কারণে ব্যয় ও সময় বেশি লাগছে।
যানবাহন স্বাভাবিকভাবে চলাচলের জন্য রেলপথের সঙ্গে অন্তত ৫ দশমিক ৭ মিটার ফাঁকা জায়গা থাকা দরকার। একইভাবে দরকার ১৫ মিটার প্রশস্ততা। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ নকশা তৈরির সময় উচ্চতা ও প্রশস্ততা এর চেয়ে কম রাখে। এ নকশা ধরে পিলারসহ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এতে আপত্তি তোলে সেতু বিভাগ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে নকশা সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। এতে সেতুর দুই প্রান্তে দুটি করে রেলের চারটি পিলার ও গার্ডার ভাঙতে হয়। বাড়াতে হয় পাইল। এতে প্রায় ৫৪ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে।
নকশার এ সমস্যা ২০২০ সালের জুলাইয়ে ধরা পড়ে। এর মধ্যে দুই সংস্থার টানাটানি, নকশা সংশোধন এবং ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে দেড় বছর বেশি সময় চলে যায়।
প্রকল্প সূত্র জানায়, ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, আগামী বছরের মে মাসে কাজ শেষ করার কথা। এখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ অন্তত দুই বছর বাড়ানো লাগতে পারে। এতে ব্যয়ও বাড়তে পারে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের কাজ বেড়েছে। সময় ও ব্যয় বাড়াতে হতে পারে।
রেললাইন নির্মাণে প্রকল্পে মূল নির্মাণকাজের ৮৫ শতাংশ অর্থ দিচ্ছে চীন। তবে শর্ত হচ্ছে চীন সরকারের ঠিক করে দেওয়া একটি মাত্র ঠিকাদার কাজটি করবে। চীনের অর্থ পাওয়া যাবে—এমন নিশ্চয়তার পর ২০১৬ সালেই চায়না রেলওয়ে গ্রুপকে (সিআরইসি) নিয়োগ দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ঋণ চুক্তি হয় ২০১৮ সাল। ফলে ঠিকাদার দুই বছর কোনো কাজ করেনি।
শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০২২ সালে। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। সময় বেড়ে হয় ২০২৪ সাল পর্যন্ত।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে বাড়তি আরও ১৫২ একর জমি লাগবে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত মিশ্রগেজ লাইন সম্প্রসারণ, কমলাপুর টিটিপাড়ায় ও নড়াইলে পাতালপথ নির্মাণ এবং অন্যান্য স্টেশন অবকাঠামোর কাজ বেড়েছে। এর জন্য আরও ১ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা বৃদ্ধি হবে। এতে ব্যয় দাঁড়াবে ৪০ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা।