১ জুন পর্যন্ত মূল সেতুর কাজ এগিয়েছে ৯৩.৫০ শতাংশ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ
পদ্মা সেতুর সড়কপথের কংক্রিটের স্ল্যাব বসানো শেষ হবে সেপ্টেম্বরে। এরপর চাইলে হেঁটেই পার হওয়া যাবে স্বপ্নের এই সেতু। রেলের কাজও এগিয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হতে পারে মাটি থেকে সেতুর সঙ্গে রেলপথের সংযোগ তৈরির কাজ। তখন রেলপথ ধরেও হেঁটে পার হওয়া যাবে সেতুটি।
১ জুন পর্যন্ত পদ্মা সেতুর সার্বিক কাজের অগ্রগতি বিবেচনায় সেতু বিভাগ আশা করছে, সব কাজ ঠিকমতো এগোলে আগামী বছরের জুনে সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য চালু করা যাবে। একই দিন ট্রেন চালুরও লক্ষ্য আছে।
অবশ্য ট্রেন চালুর বিষয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা আছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, নকশা জটিলতায় সেতুর বাইরে উড়ালপথের (ভায়াডাক্ট) একটি পিলার ভাঙতে হচ্ছে। এ কারণে সেতুর সঙ্গে সংযোগ তৈরির কাজ পিছিয়ে গেছে। সেতুর অংশের বাইরেও রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হয়নি।
গত ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর সর্বশেষ বা ৪১তম স্টিলের স্প্যান জোড়া দেওয়ার মাধ্যমে মূল সেতু দাঁড়িয়ে যায়। এতে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ার সঙ্গে শরীয়তপুরের জাজিরার সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়। দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন আর ভেতর দিয়ে চলবে রেল। এখন সেতু পারাপারের জন্য কংক্রিটের স্ল্যাব জোড়া দিয়ে রেল ও সড়কপথ তৈরি হচ্ছে। ১ জুন পর্যন্ত যানবাহন ও রেলপথের স্ল্যাব বসানোর কাজ যথাক্রমে ৮৯ শতাংশ এবং ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
প্রকল্পের অগ্রগতিসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১ জুন পর্যন্ত মূল সেতুর কাজ এগিয়েছে ৯৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টি-বন্যায় বড় কোনো সমস্যা না হলে সড়ক ও রেলপথের স্ল্যাব বসানোর কাজ সেপ্টেম্বরেই শেষ হবে। এরপর চাইলে হেঁটেই সেতু পার হওয়া যাবে। করোনা পরিস্থিতি এবং গত বছরের নদীভাঙনে কিছু সমস্যা হয়েছিল। এখন তা কাটিয়ে ওঠা গেছে। আগামী জুনেই পদ্মা সেতু চালু করা যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তবে সেতু হেঁটে পার হওয়ার উপযোগী হওয়া মানে মানুষের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে না। কারণ তখনো অনেক কাজ চলমান থাকবে।
পদ্মা সেতুতে এখন বড় কোনো কারিগরি চ্যালেঞ্জ নেই, অর্থেরও সমস্যা নেই। এমনিতেই সেতু নির্মাণে সময় বেশি লেগে গেছে। ফলে যত দ্রুত সেতু চালু করা যাবে, ততই এর সুফল বেশি পাবে মানুষঅধ্যাপক সামছুল হক, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট
প্রকল্পের অগ্রগতিসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মূল সেতুর ওপরে যানবাহন চলাচলের পথ তৈরি করতে ২ হাজার ৯১৭টি কংক্রিটের স্ল্যাব বসানোর কথা। ১ জুন পর্যন্ত বসানো হয়েছে ২ হাজার ৬০৪টি। আরও বাকি আছে ৩১৩টি স্ল্যাব। এরপর স্ল্যাবের ওপর দুই মিলিমিটারের পানি নিরোধক একটি স্তর বসানো হবে, যা ওয়াটারপ্রুফ মেমব্রেন নামে পরিচিত। এটি অনেকটা প্লাস্টিকের আচ্ছাদনের মতো। তারপর পাথর, সিমেন্ট ও বিটুমিন দিয়ে কয়েক স্তরের পিচ ঢালাই হবে। এর পুরুত্ব প্রায় ১০০ মিলিমিটার।
এ ছাড়া যানবাহন চলাচলের দুই পাশে দেয়াল ও সড়ক বিভাজক দিতে হবে, যা প্যারাপেট ওয়াল নামে পরিচিত। কংক্রিটের প্রায় ১২ হাজার ৩৯০টি স্ল্যাব জোড়া দিলে সেই দেয়াল সম্পন্ন হবে। এখন পর্যন্ত প্যারাপেট ওয়ালের স্ল্যাব বসানো হয়েছে ১ হাজার ৫৩৬টি। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্যারাপেট ওয়ালের বাকি স্ল্যাবও তৈরি হয়ে গেছে। এখন শুধু বসাতে হবে।
পদ্মা সেতুতে অন্য সেতুর মতো সড়কবাতি থাকবে। তবে বাড়তি হিসেবে পুরো সেতুতে স্থাপন করা হবে আর্কিটেকচারাল লাইটিং। এটি দিয়ে জাতীয় দিবস বা বড় কোনো উপলক্ষ এলে সেতুটি নানা রঙে আলোকিত করা যাবে। দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফা টাওয়ারসহ বড় বড় স্থাপনায় এমন আলোকসজ্জার ব্যবস্থা আছে।
নদীতে পিলারের ওপর স্টিলের কাঠামো (স্প্যান) দিয়ে তৈরি হয়েছে মূল সেতু। এর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এর বাইরে দুই প্রান্তে ঢালু উড়ালপথের মাধ্যমে মূল সেতুকে মাটির সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। ভায়াডাক্ট নামে পরিচিত এ উড়ালপথের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়াচ্ছে ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। ভায়াডাক্ট তৈরি হচ্ছে কংক্রিটের স্ল্যাব জোড়া দিয়ে। জাজিরায় সেই স্ল্যাব জোড়া দেওয়া শেষ হয়ে গেছে। মাওয়ায় মাত্র ছয়টি স্ল্যাব জোড়া দেওয়া বাকি আছে। এই মাসের মাঝামাঝি তা সম্পন্ন হয়ে যাবে বলে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের অধীনে মূল সেতুতে রেলপথ এবং সেতুর দুই প্রান্তে ৫৩২ মিটার উড়ালপথ তৈরি করছে সেতু বিভাগ। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সেতুতে রেলপথ তৈরির জন্য ২ হাজার ৯৫৯টি কংক্রিট স্ল্যাব বসানোর কথা। এর মধ্যে বসানো হয়েছে ২ হাজার ৮১৫টি। বাকি আছে ১৪৪টি।
এর বাইরে মাটি পর্যন্ত বাড়তি উড়ালপথ তৈরি, রেললাইন বসানো এবং ট্রেন পরিচালনার দায়িত্ব রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। এ কাজে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রেলওয়ে। এর আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত।
পুরো প্রকল্পের কাজ তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ঢাকা থেকে মাওয়া, মাওয়া থেকে ভাঙ্গা এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ। এর মধ্যে সেতু উদ্বোধনের দিন মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালুর অগ্রাধিকার ঠিক করেছে রেলওয়ে। এই অংশের দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার, কাজ এগিয়েছে ৭৭ শতাংশ।
এখন রেললাইন বসানো ও স্টেশনের কাজ শেষ করতে হবে। অবশ্য আগামী এক বছরে তা পুরোপুরি সম্পন্ন হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান প্রকল্প কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, সেতুর ওপরের ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার রেললাইন বসাতেই ছয় মাস লাগবে। এ জন্য গত জানুয়ারি মাসে সেতু প্রকল্পের পরিচালককে চিঠিও দিয়েছেন পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পের পরিচালক। চিঠিতে সেতু চালুর ছয় মাস আগে রেললাইন বসানোর পথ বুঝিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। জুনে সেতু চালু করলে জানুয়ারির শুরুতেই নির্ধারিত পথ বুঝিতে দিতে হবে।
তবে পদ্মা সেতু প্রকল্প সূত্র বলছে, রেলপথের পাশে গ্যাস পাইপলাইন বসানোসহ আরও কাজ বাকি আছে। রেল ও সেতুর আলাদা দুই সংস্থা এবং দুই ঠিকাদার একসঙ্গে কাজ করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের আগে রেলপথ বুঝিয়ে দেওয়া কঠিন। সে ক্ষেত্রে দুই প্রান্তে রেললাইন বসালেও সেতু চালুর প্রথম দিন ট্রেন চালানো কঠিন হবে।
পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বেশি লোকবল নিয়োগ দিলে সেতুর বাইরে হয়তো প্রতিদিন ৫০০ মিটার রেললাইন বসানো সম্ভব। তবে সেতুতে রেললাইন বসাতে ছয় মাস লাগবে বলে ঠিকাদার জানিয়েছেন। পদ্মা সেতুর চালুর দিন থেকেই ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন তাঁরা।
গত বছর বন্যায় নদীভাঙনে মাওয়ার নির্মাণ মাঠ নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পর কিছু জটিলতা তৈরি হয়। প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, এবার যে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, তাতে প্রকল্প এলাকার ভেতরে ভাঙনের আশঙ্কা কম। তবে পদ্মা নদীর গতিপ্রকৃতি জটিল, ঝুঁকি থাকেই।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, গত বন্যায় মাওয়া প্রান্তে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় খননের পর ২০ মিটারের মতো বাড়তি পলি জমেছে। সেখানে পুনরায় খনন করতে হবে। এ ছাড়া নদীশাসনের কাজ এখনো মূল সেতুর চেয়ে পিছিয়ে আছে। কাজের মোট অগ্রগতি ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সেতু বিভাগ। ২০০৭ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের সময় এর ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। পরে তিন দফা ব্যয় বেড়েছে। এখন পর্যন্ত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। কয়েক দফা বাড়িয়ে আগামী জুনে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরের এক বছর সেতুতে কোনো ত্রুটি হলে ঠিকাদার সারিয়ে তুলবে, ঠিকাদারের পাওনা থাকলে তা-ও মেটাবে সেতু বিভাগ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতুতে এখন বড় কোনো কারিগরি চ্যালেঞ্জ নেই, অর্থেরও সমস্যা নেই। এমনিতেই সেতু নির্মাণে সময় বেশি লেগে গেছে। ফলে যত দ্রুত সেতু চালু করা যাবে, ততই এর সুফল বেশি পাবে মানুষ। এই সেতু শুধু দরকারই নয়, অর্থনীতির রূপান্তরকারী একটি প্রকল্প। এটি ঘিরে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণসহ বিপুল বিনিয়োগ হয়ে গেছে। তাই এর সদ্ব্যবহারের জন্য সেতু দ্রুত চালু করতে হবে।