পদ্মা সেতু এখন বাস্তবতার পথে। বহু আলোচিত এই প্রকল্পের নানা উত্থান-পতন পর্ব ছিল। শেষ পর্যন্ত আগামী বছর জুনে চালু হচ্ছে স্বপ্নের এই সেতু। বহু মানুষের মেধা, শ্রম কাজ করেছে এর পেছনে । এরই একজন ড. আইনুন নিশাত। প্রায় দুই যুগ আগে চালু হওয়া বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণপ্রক্রিয়ায়ও বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। পদ্মা সেতু প্রকল্পে তিনি বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য হিসেবে শুরু থেকেই আছেন। একটি বৃহৎ অবকাঠামো হিসেবে এই সেতু কীভাবে বাংলাদেশকে একটি নতুন অবস্থানে নিয়ে যাবে, এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কোন মাত্রায় ও কতটুকু পড়বে— এসব বিষয় জানার চেষ্টা করা হয়েছে। সাক্ষাৎকার নয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেন
আগামী জুনের মধ্যেই পদ্মা সেতু চালুর সিদ্ধান্ত আছে সরকারে। অনেক বাধা বিপত্তি পার হয়ে এই স্বপ্ন পূরণকে কীভাবে দেখছেন?
আইনুন নিশাত: পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু বলার আগে বঙ্গবন্ধু সেতুর একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। এই সেতু দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল। ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তৃতা দেখলে দেখা যাবে, সেখানে বারবার বাংলাদেশের বন্যা ব্যবস্থাপনা এবং যমুনার ওপর সেতুর দাবি করেছেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সেতুর সমীক্ষা শুরু হলো। আমরা চাচ্ছিলাম রেল এবং রোড একসঙ্গে হোক। কিন্তু যানবাহন চলাচলের দিক বিবেচনায় সেতুটি যুক্তিযুক্ত হচ্ছিল না। সমীক্ষায় হিসাব করা হয়, এই সেতুর মাধ্যমে সরাসরি কত উপকার হবে? কিন্তু একটি সেতুর তো আরও ইনডাইরেক্ট উপকার আছে। সেটার ওপরে বিশ্বব্যাংক যখন গবেষণা চালাল, তখন চমকে উঠে লক্ষ করল রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া বাংলাদেশের বাকি অংশ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। বগুড়ার একজনকে জিজ্ঞাসা করলে বলত বাংলাদেশে যাই, মানে ঢাকায় যাই। উত্তরবঙ্গে তেমন উন্নতি নেই, শিল্পায়ন হয়নি। তখন এসব বিষয় ধরে সুবিধা হিসাব করা হলো।
একপর্যায়ে সেতু দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা হলো। সত্যি কথা বলতে কি গ্যাস পাইপলাইনের কারণেই প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিযুক্ত হয়েছে। তখন ঠিক হলো রেল, রোড, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন লাইন সবকিছু একসঙ্গে করা হবে। যমুনা সেতুর সরাসরি উপকার দিয়ে সেতুটি যুক্তিযুক্ত হয়নি। কিন্তু সেতুটি হলে সমাজের যে উপকার হবে, সেটা দিয়ে যুক্তিযুক্ত হয়েছে।
এই অভিজ্ঞতা পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে কাজে এসেছে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে যে আয়ের হিসাব করা হয়েছিল, তা প্রত্যাশার চেয়েও খুব দ্রুত পূরণ হয়েছে। এই সবই পদ্মা সেতুর পথ সুগম করেছে।
পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে কারিগরি কী কী চ্যালেঞ্জ এসেছে? বাংলাদেশের মানুষ এই সেতু থেকে প্রযুক্তিগতভাবে নতুন কী পেল?
আইনুন নিশাত: পদ্মা সেতু প্রকৌশল জগতে প্রায় অসম্ভব একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার পানি আরিচায় মিলিত হয়। এই সম্মিলিত পানি মাওয়া দিয়ে যায়। নদীটা সেখানে অদ্ভুতভাবে আচরণ করে। ব্রহ্মপুত্র সিরাজগঞ্জের কাছে ১২-১৪ কিলোমিটার চওড়া। রাজশাহীতে গঙ্গার প্রশস্ততা ছয় কিলোমিটার। তাহলে যে পানি প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রশস্ততা পার হচ্ছে, সেটা মাওয়ায় ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত নদী দিয়ে যেতে চেষ্টা করে। এ ছাড়া এই নদীতে প্রচুর পলি আছে। তা সেখানে জমে যায়। যে কারণে যেখানে পদ্মা সেতু নির্মাণ হচ্ছে, সেখানে নদী তিন কিলোমিটারের বেশি চওড়া নয়।
এই সেতুর নকশা প্রণয়নে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। একটা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভিত্তি। আমাদের দেশে নদীতে পাথর নেই। ফলে সেতুর পুরো ভার মাটির মধ্যেই রাখতে হয়। ১০ ফুট ডায়ামিটারের স্টিলের পাইল পিটিয়ে মাটির নিচে ঢোকানো হয়েছে। এই পিটিয়ে মাটিতে প্রবেশ করানোর কাজে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী যে হাতুড়ি আছে, সেটাও শেষ পর্যন্ত কাজ করেনি। তখন আমরা নকশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছি। এ জন্য যথেষ্ট জটিলতা হয়েছে।
নদী শাসন আরেকটি জটিল কাজ। বর্ষার সময় এখানে নদী নিজে নিজে ২০০ ফুট গভীর খাদের সৃষ্টি করতে পারে। কাজেই সেতু নির্মাণ করতে হলে নদীর দীর্ঘ ঢালকে রক্ষা করতে হবে। এই কাজে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তা আমাদের দেশীয়। ৮০০ কিলোগ্রাম ওজনের জিওব্যাগ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর তলদেশে ঢাল তৈরির জন্য যে পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে, এর প্রতিটির ওজন এক টন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সাধারণ ২৫০-৩০০ কিলোগ্রাম ব্যাগ ব্যবহার করে। এটা একটা সাময়িক ব্যবস্থা। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে এমন নকশা ভাবতে হয়েছে, যাতে সেতুর জীবদ্দশায় এর ক্ষতি না হয়। সেতুতে ভার পরিবহন (লোড ট্রান্সফার) হয় দুই স্প্যানের সংযোগস্থলে। অভিনব জিনিস হচ্ছে সেখানে ১০০ টনের বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের বিয়ারিং পৃথিবীর কোথাও ব্যবহার হয় না। যা ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু কতটা যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে?
আইনুন নিশাত: আমি মনে করি, আমাদের চারটি প্রধান সেতুর সংযোগ তৈরি করার মাধ্যমে পুরো দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতু, লালন শাহ সেতু ও ভৈরব সেতু আগেই নির্মিত হয়েছে। এর বাইরেও মাঝারি আকারের অনেক সেতু যোগাযোগ নেটওয়ার্ককে সমৃদ্ধ করেছে। পদ্মা সেতু চালু হলে সারা দেশের মধ্যে একটা সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে অপূর্ণতা কমে আসবে। এর মাধ্যমে দেশকে একটি অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
এখন মোংলা বন্দরের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের যোগাযোগ ভালো না। কাজেই পদ্মা সেতু বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট, খুলনাসহ ওই অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের জন্য অনেক সুবিধা বয়ে আনবে। সময় কম লাগবে। তবে মূল উপকার হবে মালামাল পরিবহনে। চট্টগ্রাম বন্দর মোংলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। মোংলা থেকে মালামাল দেশের যেকোনো স্থানে ট্রেনের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া যাবে। রেললাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করার কারণে দেশের যেকোনো জায়গায় মানুষ কিংবা মালামাল সহজ ও সাশ্রয়ী হবে।
ফেরি হচ্ছে অনিশ্চিত মাধ্যম। আর সেতু হচ্ছে নিশ্চিত ব্যবস্থা। সেতু অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দেবে। খুলনা-যশোর অঞ্চলে দ্রুত শিল্পায়ন হবে। পদ্মা সেতু চালু হলে কুয়াকাটা ও সুন্দরবন ঘিরে পর্যটন বিস্তার লাভ করবে। সবচেয়ে বড় কথা আগে মানুষে যেভাবে ফেরিঘাটে অনিশ্চয়তার মধ্যে বসে থাকত, সেই অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। জীবন সহজ হবে। প্ল্যান দেখেছি বরিশাল পর্যন্ত রেললাইন নিয়ে যাওয়া হবে। এটা দ্রুত করতে হবে। রেল যোগাযোগও দেশের সব বিভাগকে সম্পৃক্ত করবে।
এই সেতুর মাধ্যমে যাতায়াতের বাইরে আরও বেশি সুবিধা পেতে হলে কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? মোংলা বন্দর দীর্ঘদিন সামর্থ্য অনুযায়ী ভূমিকা পালন করতে পারেনি। পদ্মা সেতু এই বন্দরের সক্ষমতার পুরো ব্যবহারে কতটুকু ভূমিকা পালন করবে?
আইনুন নিশাত: দেশে একটা বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ হলে এর সুবিধা বিভিন্ন ধাপে অর্জন করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময় সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সেতুটিকে কীভাবে ব্যবহার করা যায়। একই ধরনের সমীক্ষা করা হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণের আগে। এর মূল বিষয় ছিল দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নতি কীভাবে করা যেতে পারে। সে প্রতিবেদন এখন পর্যালোচনা করা দরকার। ওই অঞ্চলের শিল্পায়ন, এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা আমাদের প্রধান লক্ষ্য হতে হবে। মোংলা বন্দরকে কীভাবে চাঙা করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। মোংলা বন্দরটি এখন যে স্থানে আছে, সেখানে দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ নেই। এই বন্দরটিকে কিছুটা ভাটিতে নিতে হবে। বর্তমান অবস্থানে মোংলা ও পায়রা বন্দরের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ আছে বলে আমি মনে করি না।
পদ্মা সেতু প্রকল্প অবকাঠামোগত ও রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশকে কোন অবস্থানে নিয়ে যাবে বলে মনে করছেন?
আইনুন নিশাত: পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্বের জন্য একটা বড় রাজনৈতিক মেসেজ। বিশ্বব্যাংক যখন ঋণ দিতে আপত্তি করল, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ওপর বিশ্বাস রেখে কাজটি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি শর্ত দিয়েছিলেন যে বিশ্বব্যাংক জড়িত থাকলে যে কোয়ালিটি কন্ট্রোল করা হতো, আমাদের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকাজে গুণগত মানের ক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজ করা না হয়। তাই অর্জিত হয়েছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আইনুন নিশাত: আপনাকেও ধন্যবাদ।