হাঁটুসমান চারটি খুঁটি। তাতে লাল নাইলনের দড়ি দিয়ে সীমানা টেনে দেওয়া। ভেতরে মাদুর বিছিয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত কিছু শিশুর দল। শ্যামলীর শিশুপার্কে প্রায় বিকেলেই দেখা মিলবে এদের।
সোহেল রানা বছর দুয়েক আগে ঢাকায় এসেছেন। ঢাকা কলেজে রসায়ন বিভাগে স্নাতকোত্তর পড়ছেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে এক বিকেলে বসেছিলেন শ্যামলী শিশুপার্কে। রাকিব নামের এক শিশু দৌড়ে এসে তাঁর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পকেটে থাকা ছোট নোটবুকে নাম লেখা শেখালেন রাকিবকে। নিজের নাম লিখতে পেরে বেশ খুশি হয় রাকিব। পরদিনও এসে নাম লেখার আগ্রহ প্রকাশ করে সে। এভাবেই একজন দুজন করে জুটে যায় বেশ বড় এক শিশুর দল। গড়ে তোলেন ‘পথশিশুদের ছায়াতল’ নামের স্কুল। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে শ্যামলী পার্কে গিয়ে কথা হয় সোহেল রানা ও তাঁর স্কুল সদস্যদের সঙ্গে।
স্মৃতি অঙ্ক করছিল। মোহাম্মদপুরের জহরী মহল্লায় থাকে। শ্যামলী শিশুপার্কে খেলতে খেলতেই একদিন সে এই স্কুলে পড়া শুরু করে। স্মৃতির মতো প্রায় ২০ জন শিশু পড়ছিল। সামনে একটি সাদা বোর্ড রাখা। কেউ কোনো বর্ণ ভালোভাবে শিখতে পারলে ওই বোর্ডে বড় করে লিখে সবাইকে দেখায়। সোহেল রানা স্কুলটি করার ব্যাপারে বলেন, ‘আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল কিছু করব। ওদেরকে শুরু দিকে শুধু নাম লেখাতাম। একসময় ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চারজন শিক্ষার্থী এসে একটি সংগঠন করার জন্য বলে। পরে ওদের নিয়েই শুরু করি।’
স্কুলের সরঞ্জাম বলতে বসার জন্য মাদুর, আদর্শলিপি বই, খাতা, কলম-পেনসিল, সাদা বোর্ড ও একটি মার্কার। খোলা আকাশের নিচেই চলে পড়াশোনা। সপ্তাহে শুক্র, রবি ও মঙ্গলবার বিকেলে দুই ঘণ্টা এ স্কুল চলে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের বয়স ৮ থেকে ১২ বছর। প্রায় সবাই কাজ করে খাওয়া শিশু। তাই অনেকেই নিয়মিত না। নাঈম প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে বোতল কুড়ায়। বিকেলে পড়তে চলে আসে। নাঈমের সহপাঠী রবিন হাসানের ইচ্ছা ইঞ্জিনিয়ার হবে। রবিন বলে, ‘গাড়ি-গুড়ি ঠিক করার ইঞ্জিনিয়ার হমু।’
শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য প্রতিদিনই হালকা কিছু খাবার দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও হয়। পড়ার পাশাপাশি শেখানো হয় সুন্দর করে কথা বলা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়। সোহেল বলেন, স্কুলটি চলে স্বেচ্ছাসেবক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাহায্যে। তাঁদের লক্ষ্য এখান থেকে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি কোনো স্কুলে ওদের ভর্তি করানো। সুবিধাবঞ্চিত এ শিশুরা যেন সমাজের শিক্ষিত মানুষের কাতারে আসতে পারে। তিন আরও বলেন, বর্ষায় একটু কষ্ট হয়। তখন পার্কের ছাতার নিচে স্বেচ্ছাসেবকেরা ছোট ছোট ভাগ হয়ে পড়ান।
তাঁদের ১৮ জন স্বেচ্ছাসেবক আছেন। যাঁরা পালা করে এখানে পড়িয়ে থাকেন। সাবিনা ইয়াসমিন আনন্দমোহন কলেজে পড়েন। ছুটি পেলেই চলে আসেন।
পথশিশুদের ছায়াতল স্কুলটি পার্কের একটি আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। স্থানীয় বাসিন্দা জসিমউদ্দিন তাঁদের প্রশংসা করলেন। পাশ দিয়ে যে-ই যাচ্ছেন, একটু থেমে দেখছেন ওদের। অবশ্য পড়ার ফাঁকে ফাঁকে শিশুদের স্বভাবসুলক দুষ্টুমি চলছে।