করোনাকালে স্থবির হয়ে ছিল সারা বিশ্ব। এর মধ্যেও প্রথম আলো শুনিয়েছে আশার গল্প; বহু উজ্জ্বল ধাপে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে গেছে সামনে। সেসব গল্প, গল্পের পেছনের রঙিন গল্প।
প্রকাশের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রথম আলো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের শীর্ষ প্রচারসংখ্যার দৈনিক পত্রিকা তো বটেই। সেটি ছিল এক দারুণ উদ্যাপনের সময়। কারণ, পেশাজীবী সাংবাদিকতাই যে হতে পারে সবচেয়ে বাণিজ্যসফল, এবং এই বাংলাদেশের মাটিতেই, প্রথম আলো ছিল তার অগ্নিপরীক্ষা।
শুধুই একটি দৈনিক পত্রিকা—যেটি হবে বস্তুনিষ্ঠ ও দলনিরপেক্ষ এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী—এটুকুই ছিল লক্ষ্য। প্রথম আলো প্রতিষ্ঠার শুরুতে এই উদ্দেশ্যটুকু নিয়েই একাগ্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সবাই। শুনতে সহজ, কিন্তু এ দুই উদ্দেশ্য পূরণই ছিল নরওয়ের দুঃসাহসী অভিযাত্রী থর হেয়ারডালের মতো হাতে তৈরি ভেলায় চেপে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার মতো দুঃসাধ্য, বিশেষ করে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের পরিসরে। তখন বলেই নয়, স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাদাবান গণমাধ্যমের জন্য বাংলাদেশ এখনো প্রশান্ত মহাসাগরের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ও টালমাটাল।
সালটা ১৯৯৮। জনতার অভ্যুত্থানে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের পর পুরো একটি দশকও পার হয়নি। গণমাধ্যমের জন্য বাংলাদেশে এর আগের ইতিহাস খানাখন্দে ভরা। স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় বাকশালের আওতায় পত্রিকার সংকোচন, ১৯৭৫ সালে সপরিবার বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড, এর সঙ্গে সঙ্গে দেড় দশকের সামরিক শাসন খাঁচার পাখির মতো গণমাধ্যমের ডানা ক্রমশ আড়ষ্ট করে এনেছিল। অকুতোভয় স্বাধীন গণমাধ্যমের পূর্বশর্ত গণতন্ত্রের মুক্ত পরিসর। এরশাদের সমরশাসনের পতনের পর খাঁচা থেকে মুক্ত গণতন্ত্র তখনো ডানার আড়ষ্টতা কাটানোর চেষ্টা করছে। দেশের প্রধান পত্রিকাগুলো সে সময়ে মোটের ওপর কোনো না কোনো দলেরই মুখপত্র। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থী, জামায়াত, এমনকি পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস খুনিদের দলটিরও। দেশের গণমাধ্যমের দুনিয়ায় এদেরই কলরব। মুক্ত ও দুঃসাহসী সাংবাদিকতা ডানা ঝাড়া দিয়ে ওড়ার অবকাশ পায়নি। প্রথম আলো প্রকাশের এই ছিল নিদারুণ পটভূমি। এই আবহাওয়ায় যে স্বপ্ন নিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল, সেটি ছিল প্রবল দুঃসাহসী।
অথচ সেটিই সম্ভব হয়েছিল, সবার একাগ্র স্বপ্নে আর সৃজনশীল শ্রমে। যদি কোনো প্রতীকে একে বোঝাতে হয়, তাহলে বলতে হবে, প্রথম আলো ছিল কঠিন পাথরের বুক থেকে গজিয়ে ওঠা সবুজ একটি তরু। এই অসম্ভব যে সেদিন সম্ভব হয়েছিল, তার পেছনে ছিল ট্রান্সকম ও মিডিয়াস্টারের প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিনিয়োগ, সম্পাদক মতিউর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর অসামান্য সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে উদ্গ্রীব একঝাঁক তরুণ সাংবাদিক।
প্রকাশের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রথম আলো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের শীর্ষ প্রচারসংখ্যার দৈনিক পত্রিকা তো বটেই। সেটি ছিল এক দারুণ উদ্যাপনের সময়। কারণ, পেশাজীবী সাংবাদিকতাই যে হতে পারে সবচেয়ে বাণিজ্যসফল, এবং এই বাংলাদেশের মাটিতেই, প্রথম আলো ছিল তার অগ্নিপরীক্ষা।
পূর্ণ হয়ে যাওয়া এই লক্ষ্যই কিছুদিনের মধ্যে হয়ে উঠল নতুন এক সূচনার পটভূমিকা। দৈনিক পত্রিকা তো হলো। চলমান অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এর বিকাশ চলতে থাকবে। কিন্তু দৈনিক পত্রিকার বাইরে কি আরও কিছু করা যায় না, প্রথম আলোর গণমাধ্যমগত বলয়কে যা আরেকটু প্রসারিত করতে পারে? আধুনিক যুগের বাণিজ্য পরিভাষায় যাকে বলে ‘পণ্যের বহুমুখীকরণ’, সে রকম কোনো সচেতন ভাবনা থেকে নয়; সৃষ্টিশীল কিছু করার প্রত্যাশায়, আরও বৃহত্তর জনসমাজে পৌঁছানোর আন্তরিক তাগিদে।
একটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পেল নতুন এক দিগন্ত। ক্রমশ, যেন প্রায় অলক্ষ্যে, সেটি যাত্রা শুরু করল একটি গণমাধ্যম হয়ে ওঠার পথে।
গণমাধ্যমের কাজ নানা মাধ্যমের সহযোগিতায় ব্যাপক জনসংযোগের মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে তথ্য, বার্তা আর বিনোদন পৌঁছে দেওয়া। এখানে তার পথ মূলত চারটি: ১. মুদ্রিত মাধ্যম। এর মধ্যে আছে পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বই ইত্যাদি। ২. সম্প্রচার মাধ্যম। রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, রেকর্ডবদ্ধ গান ইত্যাদি পড়ে এর আওতায়। ৩. ডিজিটাল মাধ্যম। এর প্রধান বাহন অনলাইন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ৪. বহিরাঙ্গন মাধ্যম, ইংরেজিতে যাকে বলে আউটডোর মিডিয়া। এই জগৎ অবশ্য সম্পূর্ণতই বিজ্ঞাপনী প্রচারণার।
সেই যে বলেছি আনুভূমিক বিস্তার, প্রথম আলো সে বিস্তারে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ক্রমশ। শুরুটা তো সেই ধ্রুপদি মুদ্রিত মাধ্যমে, দৈনিক পত্রিকায়। ২০০৯ সালে প্রথমা প্রকাশনের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে বই প্রকাশের সৃজনী জগতে প্রবেশ। চারটি বাংলা একাডেমিসহ এ পর্যন্ত ২২টি পুরস্কার পেয়েছে প্রথমার বই। কিন্তু ২০০৯ সাল ছিল প্রথম আলোর জন্য অন্য দিক থেকে অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমআলোডটকম নামের নিউজ পোর্টালের মধ্য দিয়ে সে বছরই ডিজিটাল মাধ্যমে হলো তার নতুন আবির্ভাব। নতুন আবির্ভাব, তবে অভিষেক নয়। সে কথায় পরে আসব।
এ–ই শেষ নয়। তবে কথা হলো, আউটডোর মিডিয়ার প্রচারণাময় অঙ্গটি বাদ দিলে গণমাধ্যমের সব বর্গেই প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়ল। মাধ্যম বহু হলো, কিন্তু প্রথম আলোর পেছনে যে বিশ্বাস, মূল্যবোধ আর দার্শনিক অবস্থান ছিল, সেটিই সক্রিয় আর সজীব ছিল এগুলোর মর্মে। মানুষের ভালোবাসার হাত ধরে তাদের যে ধারাবাহিক সাফল্য এসেছে, এটিই সম্ভবত তার কারণ।
২০১১ সালে প্রকাশিত হলো প্রতিচিন্তা, সমাজ–রাজনীতি নিয়ে ত্রৈমাসিক জার্নাল। এরপর তরুণদের মাসিকপত্র কিশোর আলো প্রকাশিত হলো ২০১৩ সালে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে উঠল দেশের শীর্ষ কিশোর পত্রিকা। এল আরও মাসিকপত্র। ২০১৬ সালে বিজ্ঞানচিন্তা আর ২০২০ সালে চলতি ঘটনা, পরপর। ঈদসংখ্যা বা বর্ণিল–এর মতো আরও নানা অনিয়মিত প্রকাশনা তো আছেই।
মুদ্রিত মাধ্যমের বাইরে সম্প্রচার মাধ্যম হিসেবে প্রথম আলোর মুকুটে যুক্ত নতুন পালক চরকি। চলচ্চিত্রের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিপুল প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে এ বছরই। এরই মধ্যে প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছে বিপুল। এর সম্ভাবনার পথ এখনো ভবিষ্যতের গভীরে।
তবে সম্প্রচার মাধ্যমের পথে প্রথম আলো পা বাড়িয়েছিল আগেই। ২০০৭ সালে ট্রান্সকম লিমিটেড শুরু করেছিল এবিসি রেডিও নামে একটি এফএম বেতার। পরে সেটি মাতৃপ্রতিষ্ঠান মিডিয়াস্টার লিমিটেডের ছায়াতলে প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত হয়।
বলেছিলাম, ২০০৯ সালে প্রথমআলোডটকমের নতুন আবির্ভাব হয়েছিল, প্রথম আলোর অনলাইন অভিষেক কিন্তু নয়।
ডিজিটাল পরিসরে নিউজ পোর্টালের ধারণা খুব বেশি দিনের নয়। ১৯৮০–র দশকে নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা শুরু হলেও অন্তর্জালের জগতে সুব্যবস্থিত প্ল্যাটফর্মে বার্তা পরিবেশনের ধারণা আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেই দানা বাঁধতে থাকে ২০০৫ সালের পর থেকে। এরপর প্রযুক্তির নানা উদ্ভাবনার ধাপে পা ফেলে ফেলে এটি ক্রমশ সুস্পষ্ট আকার পেতে শুরু করে।
৪ নভেম্বর ১৯৯৮ সালে প্রথম আলো যেদিন প্রকাশিত হয়, ঘটনাক্রমে অন্তর্জালের জগতে প্রথম আলোর নিয়মিত উপস্থিতিও সে দিন থেকেই। আক্ষরিক অর্থেই অদূর ভবিষ্যতের ইশারাভাষা পড়তে প্রথম আলো ভুল করেনি। এরপর মুদ্রিত পত্রিকার হুবহু অনলাইন প্রতিরূপ হয়ে এল ই–পেপার। অনলাইন উপস্থিতি প্রথম আলোর গণমাধ্যম হয়ে ওঠার পুরো অভিজ্ঞতাই আমূল পাল্টে দিল।
এই পালাবদলের নানা মাত্রা। সেসব অন্যত্র আলোচনার বিষয়। আমরা এখানে আপাতত একটির দিকেই তাকাব। ১৯৯৮ সালে প্রথম আলো যখন পত্রিকা হিসেবে বের হলো, তখন এর ভোক্তা ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় সীমানার ভেতরের বসবাসকারীরা মাত্র। অনলাইন রাষ্ট্রের সীমানা মুছে দিল। ভোক্তা হয়ে উঠল জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক। আমরা বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলাম, বাংলা পাঠক প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে গুঞ্জন তুলতে শুরু করেছে সারা পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকে। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী বাঙালির যোগাযোগের বৃহত্তম ক্ষেত্র হয়ে উঠছে প্রথম আলো অনলাইন।
প্রথম আলোর আগের পর্বকে যদি বলি আনুভূমিক বিস্তারের, এই পর্বটি তাহলে আলম্ব উত্থানের। ডিজিটাল পরিসরের ব্যবহার, বৈশিষ্ট্য, অভিজ্ঞতা এতটাই আলাদা এবং প্রযুক্তির মুহুর্মুহু অগ্রগতির কারণে দ্রুত পরিবর্তনশীল যে মুদ্রিত জগতের সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না। পত্রিকার পৃষ্ঠাসংখ্যা সীমিত; অনলাইনে কোনো সীমানারেখা নেই। পত্রিকার মূল ভর লেখায়, সঙ্গে ছবি–কার্টুন–ইনফোগ্রাফিকস; অনলাইনে লেখার পাশাপাশি কত কী—ভিডিও, অডিও, ইন্টার–অ্যাকটিভ গ্রাফিকস ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও কত কী যে এখনো আসার পথে। পত্রিকা পড়ার একটাই পথ, নগদ টাকায় আপনাকে এক কপি কিনে নিতে হবে; অথচ অনলাইনে আসার পথ অজস্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তৈরি করে দিয়েছে আরও হাজারো গলিপথ—যার যার রুচি অনুযায়ী।
এসব শত পথে যেভাবে পাঠক এসেছে, তাতে বিশ্বগণমাধ্যমের মানচিত্রে প্রথম আলো বলার মতো বড় ঘটনাই ঘটিয়েছে বলতে হবে। মাসে ১ কোটি ৪০ লাখ ইউজার আর ২৫ কোটি পেজভিউ নিয়ে প্রথম আলো এখন পৃথিবীর শীর্ষতম বাংলা গণমাধ্যম। ১ কোটি ৭০ লাখ অনুসারী নিয়ে প্রথম আলোরটিই শীর্ষতম বাংলাদেশি ফেসবুক পেজ।
ফেসবুকের কথা যখন এলই, আরও দুটো পরিসংখ্যান এখানে দেওয়া যায়। এই লেখাটি লেখা অব্দি অনুসারীর সংখ্যার হিসাবে প্রথম আলোর ফেসবুকের অবস্থান সারা বিশ্বের দৈনিক পত্রিকার বর্গে নবম, দক্ষিণ এশিয়ার গণমাধ্যমে পঞ্চম।
সময় বয়ে চলে। নানা ঘটনার বিপুল চাপে ইতিহাস আমূল পাশ ফেরে। স্বপ্নও তখন আগের দিগন্ত থেকে বৃহত্তর কোনো নতুন দিগন্তের দিকে পৌঁছায়। সেই বদলে যেতে থাকা স্বপ্নেরই মায়াবী শক্তিতে শুরুর দিনের প্রথম আলো পত্রিকা এখন সারা বিশ্বে বাংলা ভাষার বৃহত্তম গণমাধ্যম।
সাজ্জাদ শরিফ: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক