টিসিবির পণ্য বিক্রি

পকেটে যা আছে তাতে হবে না, আরও লাগবে, তাই আবার টাকা ধার

ধার করে টাকা এনে টিসিবির ট্রাকে পণ্য কিনতে গেছেন আবদুর রহমান। গতকাল দুপুরে বনানী কাঁচাবাজার এলাকায়
ছবি: ড্রিঞ্জা চাম্বুগং

বনানী কবরস্থানে মালির কাজ করেন আবদুর রহমান। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সোয়া একটার দিকে পরিচিত একজনের কাছে খবর পান, বনানী কাঁচাবাজারের পাশে টিসিবির পণ্য নিয়ে ট্রাক এসেছে। তখন তাঁর পকেটে ছিল মাত্র ২১০ টাকা। আরেক মালি মামুনকে অনেক বলেকয়ে ৫০০ টাকা ধার নিয়ে ছুটে যান টিসিবির ট্রাকের কাছে।

ঠিক যেখানটায় টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) ট্রাক এসে থেমেছে, সেখান থেকে কবরস্থানের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। হেঁটে এই পথটুকু পাড়ি দিয়ে ট্রাকের সামনে আসার পর জানতে পারেন পণ্য বিক্রি হচ্ছে ‘প্যাকেজ’ পদ্ধতিতে। অর্থাৎ ট্রাকে থাকা সয়াবিন তেল, মসুর ডাল (মোটা দানা), চিনি, পেঁয়াজ, ছোলা ও খেজুর—এই ছয় পণ্য নির্ধারিত পরিমাণে একসঙ্গে কিনতে হবে। লাগবে সর্বমোট ৯৪০ টাকা। কিন্তু ধার করার পরও তাঁর পকেটে আছে ৭১০ টাকা। পরে আবার কবরস্থানে ফিরে যান। যাঁর কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার করেছিলেন, সেই মামুনের দ্বারস্থ হন আবার।

মামুন আর আবদুর রহমানের বাড়ি একই এলাকায়, চাঁদপুরের মতলবে। বাড়িতে গতকালই কিছু টাকা পাঠানোর কথা ছিল মামুনের, সেটি জানতেন আবদুর রহমান। আরও ৫০০ টাকা ধার দেওয়া নিয়ে প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও পরে দিতে রাজি হন মামুন। সেই টাকা নিয়ে আবার কবরস্থান এলাকা থেকে বনানী কাঁচাবাজার পর্যন্ত যেতে হয় তাঁকে। ভাগ্য ভালো তাঁর, লাইন তখন খুব একটা দীর্ঘ ছিল না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পণ্য কেনার সুযোগ পান তিনি।

বনানী কবরস্থান ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। আবদুর রহমান সিটি করপোরেশনের কর্মী নন। তবে সারা দিন সেখানেই পড়ে থাকেন। কেউ জিয়ারত করতে গিয়ে স্বজনের কবরের চারপাশের আগাছা পরিষ্কারের জন্য বা কবরের পাশে ফুলগাছ লাগানোর কাজ দিলে সেটি করে দেন তিনি। ওই ব্যক্তি ‘খুশিমনে’ যা দেন, সেটিই তাঁর মজুরি। দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা হাতে আসে তাঁর।

গতকাল দুপুরে টিসিবির পণ্য কেনার পর কথা হয় আবদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে বাড্ডা নতুনবাজার এলাকায় একটি বাসায় ‘সাবলেট’ (সহভাড়াটে) থাকেন। এক কক্ষের জন্য ভাড়া দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। তাঁর ছেলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামের একটি স্কুলে পড়েছে। অভাব-অনটনের কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি। এখন তাঁর সঙ্গে কবরস্থানে মালির কাজ করে। তিনি জানান, তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বড় মেয়ে চাঁদপুরের মতলবে স্বামীর সঙ্গে থাকে। ছোট মেয়ে স্বামীর সঙ্গে গাজীপুরের টঙ্গীতে থাকেন।

বনানীতে টিসিবির পরিবেশক ছিল মেসার্স নুহাশ স্টোর। টিসিবির দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, গতকাল তাদের পণ্য বিক্রি করার কথা ছিল কড়াইল বস্তিসংলগ্ন টিঅ্যান্ডটির আনসার ক্যাম্প এলাকায়। প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক গতকাল দুপুর ১২টায় প্রথমে আনসার ক্যাম্প এলাকায় যান। তখন সেখানে ৩০ জনের মতো নারী-পুরুষ টিসিবির ট্রাকের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ এসেছিলেন সকাল নয়টায়। বেলা একটা পর্যন্ত টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাক সেখানে না যাওয়ায় একেক করে লোকজন ফিরে যেতে থাকেন। সেখানে টিসিবির ট্রাক না যাওয়ার কারণ জানতে ঢাকা উত্তর সিটির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের কার্যালয়ে (কড়াইল বস্তির ওই অংশ ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন) যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। কার্যালয় থেকে জানানো হয়, ট্রাক দেওয়া হয়েছে বনানী কাঁচাবাজারের পেছনে কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে। বেলা দেড়টায় দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, টিসিবির ট্রাক পণ্য বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছে।

টিসিবির পরিবেশকের বিক্রয় প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে বনানী কাঁচাবাজারে আসতে বলা হয়েছে।

হঠাৎ স্থান পরিবর্তনের বিষয়ে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত রোববার বনানী টিঅ্যান্ডটি মাঠে দেওয়া হয়েছে। আজকেও (গতকাল) যদি আবার সেখানে দেওয়া হয়, তাহলে অন্য এলাকার লোকজন বঞ্চিত হবে। সবাইকে সুযোগ দিতেই স্থান পরিবর্তন করেছেন তাঁরা।

ঢাকার দুই সিটিতে এখন শুক্রবার ও সরকারি বন্ধের দিন ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে টিসিবির ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। তবে ওয়ার্ডের কোন জায়গায় ট্রাক যাবে, প্রতিদিন তা ঠিক করেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তবে একেক দিন একেক জায়গায় ট্রাক যাওয়া নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই রয়েছে। কেউ বলছেন এতে ভোগান্তি বাড়ে। আবার কেউ বলছেন প্রতিদিন একই জায়গায় গেলে সবাই পণ্য কেনার সুযোগ পান না। ঘুরেফিরে কিছু লোক প্রায় প্রতিদিনই পণ্য কিনে বাড়তি দামে বিভিন্ন দোকানে তা বিক্রি করে দেন। এতে যাঁদের প্রয়োজন, তাঁরা বঞ্চিত হন।

গতকাল টিসিবির একেকটি ট্রাকে ১ হাজার কেজি করে পেঁয়াজ ও ছোলা, ৫০০ কেজি করে চিনি ও ডাল, ২৫০ বোতল (২ লিটারের) সয়াবিন তেল ও ২৫০ কেজি খেজুর দেওয়া হয়েছে। একেকজন ক্রেতার কাছে পাঁচ কেজি করে পেঁয়াজ ও ছোলা, দুই কেজি করে চিনি ও ডাল, এক বোতল সয়াবিন তেল ও এক কেজি খেজুর বিক্রি করা হচ্ছে। সব পণ্যের সমন্বিত এ প্যাকেজের দাম পড়ছে ৯৪০ টাকা।

টিসিবির দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী একেকজন ক্রেতার কাছে চার কেজি করে ছোলা বিক্রি করার কথা। কিন্তু বনানীতে টিসিবির পরিবেশক মেসার্স নুহাশ স্টোরের বিক্রয় প্রতিনিধিরা পাঁচ কেজি করে ছোলা বিক্রি করেন। এ বিষয়ে বনানীতে টিসিবির পরিবেশকের বিক্রয় প্রতিনিধি শহিদুল ইসলামের দাবি, ক্রেতাদের অনুরোধে পাঁচ কেজি করে বিক্রি করছেন তাঁরা।

তবে পণ্য কিনতে যাওয়া অনেকেই ‘প্যাকেজ’ পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। কারণ, প্যাকেজের আওতা বড় হওয়ায় প্রায় এক হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। যাঁর যে পণ্য প্রয়োজন, তিনি যাতে সেই পণ্য কিনতে পারেন, সেই ব্যবস্থা চান তাঁরা।