১ মে ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে দেখতে পাই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তৌহিদুল ইসলাম খান (২৪) আর বেঁচে নেই। খবরটি দেখার পর থেকেই একধরনের শূন্যতা অনুভব করি। কেমন যে লেগেছিল তা ভাষায় বলে বোঝানো যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে অন্য ছাত্রদের ফোন দিয়ে ঘটনা জানার চেষ্টা করি।
পরে জানতে পারি, ময়মনসিংহ শহরে এক ছাত্র মেসে নিজের রুমে সন্ত্রাসী হামলায় নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় তৌহিদুল ইসলাম খান। আল্লাহ তৌহিদকে জান্নাতবাসী করুন। ওর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করি।
আমি স্তব্ধ হয়ে যাই কিছু সময়ের জন্য। সাহরি খেতে উঠে খাবার আর খেতে পারেনি। খাবারের থালাটি টেবিলের ওপর রয়ে গেছে। দেহটি পড়েছিল মেঝেতে, কী নিশ্চল! কী নীরবে! যে নীরবতা আমরা কেউ কারও জন্য কামনা করি না। মানুষ কি নির্মম আর পাষণ্ড হতে পারে, আমি চিন্তা করতে পারি না! আমি যদি এত কষ্ট অনুভব করি, তাহলে ওর পিতা-মাতার কী অবস্থা? ভাবা যায় কি? যে ছেলেকে এত কষ্ট করে বড় করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছে এবং সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে, তার এমন পরিণতি কীভাবে ওর মা–বাবা মেনে নেবেন? একটি ছেলে বা মেয়েকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো কি যে কঠিন! যে বা যাঁদের ছেলেমেয়ে ভর্তি হয়নি, তাঁরা বুঝতে পারবেন না। কিন্তু সচেতন নাগরিক সমাজ তা সহজেই উপলদ্ধি করতে পারে।
তৌহিদুল ইসলাম খানের পিতা ও মাতার স্বপ্নগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে। সেটা নিয়ে ভাবছি না। পিতামাতার এক অনন্য শান্তি অনুভূত হয়, সেই মুখ আর কোনো দিন দেখতে পারবেন? সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। আর এখন তৌহিদের পিতা-মাতা বেঁচেও বেঁচে নেই। জীবন্ত লাশের মতো জীবন যাপন করতে হবে তাঁদের, আমি এটাই মনে করি। তৌহিদুল ইসলাম খান ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ১০ম ব্যাচের ছাত্র (২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ)। আমাদের প্রিয় ছাত্র তৌহিদুল ইসলাম সন্ত্রাসী হামলায় মৃত্যুবরণ করে। আজ ১৭ দিন অতিবাহিত হতে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী শান্তিতে নেই। তাঁরা সবাই অপেক্ষা করছে বিচারের জন্য।
মৃত্যু! এক নির্মম, কঠিন বাস্তবতার নাম! এ থেকে কেউ রেহাই পাবে না, হোক সে এক্কেবারে রাজা, মিসকিন অথবা সম্পদশালী। মৃত্যু যেকোনো বয়সের, যেকোনো মানুষের সামনে, যেকোনো সময়ে উপস্থিত হতে পারে! কিন্তু তৌহিদের মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। অপরাধীর তো কোনো ক্ষতি হয়নি, ক্ষতি হয়েছে দেশের, পরিবার হারিয়েছে তাদের এক অমূল্য সম্পদ, যা আর কোনো দিন ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু তৌহিদের হত্যায়, দেশ, জাতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় হারাল এক মেধাবী সন্তানকে।
ছেলেটির বুকে রক্তের ছাপ এবং গভীর ক্ষত ছিল। শুনতে পাই কেউ তাকে রড দিয়ে মারাত্মক আঘাত করেছে, যার ফলে সে মারা যায়। অর্থাৎ এটা খুন! ওর সহপাঠী, শিক্ষক, ওর স্বজন—সবাই বিস্মিত, ব্যথিত, ক্ষুব্ধ। কিন্তু সবচেয়ে বড় দুঃখ তো ওর মা–বাবা পেয়েছেন, তাঁদের কোনো কিছু দিয়েই তো সান্ত্বনা দেওয়া সম্ভব নয়। পরিবারের শোক আর স্বজন হারানোর বেদনা এখনো কাটেনি। হয়তো আজও মেধাবী সন্তানের হাসিমাখা মুখের কথা ভেবে ভেবে নির্ঘুম রাত কাটে তাঁদের।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিরলস চেষ্টায় ৩ মে অপারধীকে গ্রেপ্তার করে ময়মনসিংহের পুলিশ। এই করোনাকালীন দুর্যোগে অল্প সময়ের মধ্যে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারায় ময়মনসিংহের পুলিশকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিছুটা বিলম্বে হলেও তারা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনেছে।
আমরা অপেক্ষা করছি, কখন আমরা শুনব যে ওই অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে, তার জন্য। ওর মা–বাবা, সহপাঠী এবং আমরা সবাই শান্তি পাব। সংক্ষিপ্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে অপরাধীর যে জবানবন্দি তুলে ধরা হয়েছে তা সাধারণভাবে শিক্ষার্থীসহ নিহতের পরিবারকে মর্মাহত করেছে। তারা মনে করছে, অপরাধীর সঙ্গে হয়তো অন্য কেউ জড়িত থাকতে পারে। হয়তো আরও গভীর তদন্তের স্বার্থেই এটা করা হয়েছে। তাই এ বিষয়টি পুলিশ আরও গভীরভাবে বিবেচনা করতে পারে। কারণ, গণমাধ্যমে প্রকাশিত, তৌহিদের গায়ে আঘাতের ধরন এবং অপরাধীর জবানবন্দির মধ্যে অসংলগ্নতা রয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
জাককানইবির আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি একটাই, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠ বিচার ও শাস্তির বাস্তবায়ন। পুরো জাতির কামনা, এ ধরনের অপরাধীরা যেন কোনোভাবেই বিচার থেকে রেয়াই না পায়। যেখানে আমাদের দেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেই মুহূর্তে এসব ঘৃণিত মানুষকে কোনোভাবে ক্ষমা করার কোনো অবকাশ নেই।
বরং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দৃষ্টান্তমূলক বিচারের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে একটি স্বস্তির খবর দেবে বলে আশা করছি। সুষ্ঠ বিচার না হলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। তাই আমি চাই না প্রিয় ছাত্রছাত্রী রাস্তায় নেমে যাক, শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হোক! তাই ন্যায় ও সুষ্ঠু বিচারই এর সমাধান। তৌহিদকে ওর বাবা-মা আর ফিরে পাবে না, অন্তত ন্যায়বিচার পেলে তাঁরা বাকি জীবনে কিছুটা হলেও শান্তি পাবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও দায়িত্ব রয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচারে যথাযথ সহয়তা দেয়া। আমি মনে করি, প্রশাসন তা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়কে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নিলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা আরও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। যখন এই জাতীয় ঘটনা ঘটে, তখনই আমরা একটু সচেতন ও মানববন্ধন করে থাকি। অন্যথায় আমাদের ঘুম ভাঙে না। এটাই হলো আমাদের দোষ। কিছুদিন পার হলে সময়ের পরিক্রমায় সবই ধামাচাপা পড়ে যায়।
আমরা চাই মেসমালিক, প্রশাসনসহ সবাইকে এ ব্যাপারে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কারও মায়ের বুক খালি না হয়।
*লেখক: পিএইচডি ফেলো, জংনান ইউনিভার্সিটি অব ইকোনমিকস অ্যান্ড ল, উহান, চীন এবং শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ