সচ্ছলতার আশায় ইতালি বা গ্রিসে যেতে ঝুঁকি নিচ্ছেন মাদারীপুরের তরুণেরা। প্রবাসী আয়ে দেশের সবচেয়ে কম দারিদ্র্যের জেলার দ্বিতীয় অবস্থানে মাদারীপুর।
ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে ২০১৮ সালের এপ্রিলে দেশ ছাড়েন মাদারীপুরের সদর উপজেলার মধ্য পেয়ারপুর গ্রামের তরিকুল (২২)। এ জন্য প্রথমে যান তিনি ভূমধ্যসাগর পারের আফ্রিকার দেশ লিবিয়ায়। জুনের শেষের দিকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে অন্যদের সঙ্গে লিবীয় উপকূল থেকে নৌকায় চেপে বসেন তরিকুল। তবে সাগরের অপর পারে ‘স্বপ্নের দেশ’ ইতালি পৌঁছার আগেই তাঁদের নৌকাটি ডুবে যায়। আরও কয়েকজনের সঙ্গে নিখোঁজ হন তরিকুল। এ পর্যন্ত তাঁর খোঁজ পায়নি পরিবার।
তরিকুলের কথা তুলতেই কেঁদে ফেলেন মা হিরণ বেগম। নিজেকে কোনো রকমে সামলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দালাল জামালকে ফোন করে বলেছি, আমার একটা ছেলে সৌদি গিয়ে মারা গেছে, লাশটা দেখি নাই। আমার এই ছেলেটারে ভিক্ষা দে। আমার যা আছে, সব তোরে দিয়া দেব। ছেলেরে আর ফিরে পাই নাই।’ হিরণ বেগম বলেন, লিবিয়া থাকার সময় একবার দালালদের মারধরের শিকার হয়ে বাড়িতে ফোন করেছিলেন তরিকুল। তখন বসতভিটা বিক্রি করে ছেলেকে ফেরত আনতে চেয়েছিলেন।
একই নৌকাডুবির ঘটনায় সাগরে নিখোঁজ হন মধ্য পেয়ারপুর গ্রামের আরেক তরুণ রুবেল তালুকদার। তাঁর মা শাহানা বেগমও ছেলের খোঁজ পেতে আকুল হয়ে আছেন। তিনি বললেন, ‘কেউ বলে বেঁচে আছে, কেউ বলে নাই!’
নিখোঁজ সন্তানের জন্য এই দুই মায়ের কান্না থামছে না। এরপরও অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণ নৌযাত্রায় ইতালি যাওয়াও থামছে না এ জেলার তরুণদের। স্থানীয় লোকজন জানান, এই মধ্য পেয়ারপুর গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরের কেউ না কেউ ইতালিপ্রবাসী। ছেলেরা একটু বড় হলেই ইতালি যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি জেনেই তাঁরা দেশ ছাড়েন ভাগ্যবদলের আশায়। তরিকুল ও রুবেলের দুই পরিবারের দুই ছেলেও বর্তমানে ইতালি আছেন।
মধ্য পেয়ারপুরের মতো মাদারীপুর জেলার প্রায় সব গ্রামের চিত্রই অভিন্ন। সদর উপজেলা থেকে শুরু করে রাজৈর, শিবচর, সদর, কালকিনি ও ডাসার—সব উপজেলার প্রায় ঘরে ঘরে ইতালিপ্রবাসী রয়েছেন।
রাজৈর উপজেলার হাসানকান্দি এলাকায় একটি জায়গা এখন ‘ইতালি মোড়’ নামে পরিচিতি। এ মোড়ের চারপাশে রাজৈর উপজেলার হাসানকান্দি, পশ্চিম হাসানকান্দি, সাতবাড়িয়া এবং সদর উপজেলার শিরখাড়া, কুঁচিয়াবাজার, রাজারহাট এলাকা।
ইতালি মোড়ের লোকজন বলেন, এলাকার অধিকাংশ বাড়িতে ইতালিপ্রবাসী আছেন। অনেক বাড়ির দুজন করেও ইতালিতে আছেন। তাঁদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। পরিবারে সচ্ছলতা ফিরেছে। সবারই প্রায় পাকা বাড়ি। স্থানীয় লোকজন বলেন, আগে যাঁরা গেছেন, তাঁদের উন্নতি দেখে অন্যরাও জমি বিক্রি করে বা সুদে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন।
প্রাণহানির ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে ইতালি মোড়ের পাশে হাসানকান্দির বাসিন্দা মনজেত খন্দকার বলেন, ‘লিবিয়া হয়ে যাওয়া মানে মরণ হাতে নিয়ে যাওয়া। এখন পর্যন্ত এই এলাকার কেউ মারা যায়নি। তবে আশপাশের বিভিন্ন এলাকার অনেকে সমুদ্রে হারিয়ে গেছেন।’ মনজেত খন্দকারের ছেলে সাগর খন্দকারও তিন মাস আগে ইতালিতে গেছেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, শুধু লিবিয়া হয়ে নয়, ভারত, দুবাই, তুরস্ক হয়েও নৌকায় করে ইতালি যাচ্ছেন এখনকার তরুণেরা। কেউ কেউ সাগরে ডুবে মারা যাচ্ছেন। অনেকে উদ্ধারের পর ফিরে আসেন। দীর্ঘ যাত্রাপথের কোথাও কোথাও ধরা পড়ে কারাগারেও যেতে হচ্ছে কাউকে কাউকে। সাগরে নৌকাডুবির ঝুঁকি জেনেই তাঁরা দেশ ছাড়ছেন।
ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হয়ে ২০১৮ সালে দেশে ফেরা রাজীব মীরের পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই দালালের বিরুদ্ধে। হাসানকান্দির রাজীব বললেন, সাগর পাড়ি দিতে ঝুঁকির কথা জেনেই সবাই যান। তিনি বলেন, তিনিসহ ১০৫ জন ছিলেন নৌকায়। নৌকাটি উল্টে গেলে ১৬ জন বাংলাদেশি সাগরে তলিয়ে যান।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম বলছে, ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নিখোঁজ বা মারা গেছেন ২২ হাজার ৮৪৫ জন। এর মধ্যে চলতি বছরে এ পর্যন্ত হারিয়ে গেছেন ১ হাজার ৫৫৯ জন। বেশির ভাগেরই মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। আবার উদ্ধার হলেও পাসপোর্ট না থাকায় অধিকাংশের পরিচয় নিশ্চিত করা যায় না।
সর্বশেষ গত ১৯ জুলাই তিউনিসিয়ার উপকূলে নৌকাডুবিতে ১৭ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। এর মধ্যে পাঁচজন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার।
তবে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছার ক্ষেত্রে গতবারের মতো এ বছরও দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন বাংলাদেশিরা। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ইতালিতে যাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে ২৮ শতাংশই তিউনিসিয়ার নাগরিক। এরপরই বাংলাদেশিদের অবস্থান, ১৩ শতাংশ।
ইউরোপ যেতে বয়স ছয় বছর বাড়িয়ে পাসপোর্ট করেছিলেন রাজীব মীর। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের শুরুর দিকে দুবাই হয়ে লিবিয়া যান তিনি। দুই মাস সেখানে একটি ঘরের মধ্যে গাদাগাদি করে রাখা হয় তাঁকেসহ অন্য বাংলাদেশি ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের। খাওয়ার জন্য একবেলা রুটি দিত। একদিন মধ্যরাতে নৌকায় তুলে দেওয়া হয় তাঁদের। সাগর তখন উত্তাল। সকালে একটি হেলিকপ্টার আসে, তবে সাহায্য না করে সেটি চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই নৌকাটি উল্টে যায়। এরপর সাঁতরাতে সাঁতরাতে অনেকে মিলে নৌকাটি সোজা করেন। ১০৫ যাত্রীর অধিকাংশই আবার নৌকায় উঠতে পারেন। কিন্তু ১৬ জন বাংলাদেশি তলিয়ে যান। এক দিন পর লিবিয়ার সীমান্তে ফেরে নৌকাটি। পাড়ে নামার আগেই আফ্রিকার এক নারী মারা যান। আরও কয়েকজন মারা যান হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে। মাঝে স্যাটেলাইট ফোনে লিবিয়ায় থাকা দালাল দুলালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাহায্য পাননি।
রাজীব মীর জানান, পাড়ে নামার পর মাফিয়া চক্র তাঁদের বিক্রি করে দেয় একটি গ্রুপের কাছে। তারা আটকে রাখে। টাকার জন্য চাপ দেয়। টাকা দিতে না পারায় মারধর করে। সেখান থেকেও দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন জানিয়ে রাজীব বলেন, চার দিন পর বাড়িতে ফোন করেন। সাড়ে তিন লাখ টাকা পাঠিয়ে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। এরপর ত্রিপোলিতে এক স্বজনের কাছে যান। কিছুদিন পর কাজও শুরু করেন। তবে অসুস্থ হয়ে পড়েন; কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে থাকে। আরেক দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করে দেশে ফিরে ওই বছরের ডিসেম্বরে। এখনো মাঝেমধ্যে কাশির সঙ্গে রক্ত আসে জানিয়ে রাজীব বলেন, ‘বেঁচে ফিরেছি। এভাবে আর বিদেশে যেতে চাই না।’
বিদেশে যেতে নিয়মিত প্রতারিত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও মামলা করতে আগ্রহ দেখায় না অধিকাংশ ভুক্তভোগী পরিবার। জেলা পুলিশ সূত্র বলছে, অনেকেই মামলা করেন না। মামলা করার পর সমঝোতাও করেন অনেকে। তবে সম্প্রতি মানব পাচার আইনে মামলা করার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ সালে মানব পাচার আইনে মামলা হয় দুটি। পরের বছর হয় মাত্র একটি। এ দুই বছরে কেউ গ্রেপ্তার হননি। ২০১৯ সালে তিনটি মামলায় তিনজন গ্রেপ্তার হন। পরের বছর মামলা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১টিতে, আর গ্রেপ্তার হন ৩৫ জন। এ বছরের প্রথম ১০ মাসে (অক্টোবর পর্যন্ত) ৩০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপে, বিশেষ করে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা বেশি এ জেলায়। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশের কাছে আসেন। এর বাইরে কেউ প্রতারিত হয়েছে বা জোরপূর্বক নিয়ে গেছে, এমন অভিযোগ সাধারণত কেউ করেন না। তবে পুলিশ নিজস্ব উৎস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালায়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে মামলা করায় উৎসাহী করা হয়।
সর্বশেষ আদমশুমারি অনুসারে, মাদারীপুরের জনসংখ্যা ১২ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন। প্রতি পরিবারে গড়ে ৪ জন করে সদস্য ধরলে পরিবারের সংখ্যা ৩ লাখ ৩ হাজার। স্থানীয় লোকজন মনে করেন, প্রতি পরিবারের অন্তত একজন ভাগ্যবদলের আশায় বিদেশে গেছেন। সে অনুযায়ী এ জেলার ইতালিসহ বিদেশ যাওয়া মানুষের সংখ্যা তিন লাখের কম নয়।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাবে, বিদেশে বৈধ কর্মসংস্থানের দিক থেকে ২৩তম জেলা মাদারীপুর। ২০০৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বৈধভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গেছেন জেলার ১ লাখ ২৩ হাজার জন। তবে স্থানীয় লোকজন বলছেন, এর বাইরে একটি বড় অংশ অবৈধ পথে ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছেন। বিশেষ করে ইতালি ও গ্রিসে আছেন অনেকে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক সমীক্ষা বলছে, দেশের সবচেয়ে কম দারিদ্র্যের জেলার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে মাদারীপুর। শীর্ষে থাকা নারায়ণগঞ্জে রয়েছে শিল্প–কলকারখানা। মাদারীপুর শিল্প জেলা নয়। প্রবাসীদের আয়ে এমনটি সম্ভব হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা।
তবে জেলায় বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। মাদারীপুর পৌরসভার তথ্য বলছে, শুধু শহরে দিনে গড়ে পাঁচটি সালিস আসে বিবাহবিচ্ছেদ–সংক্রান্ত। বছরে দেড় শতাধিক বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে। মাদারীপুর পৌর মেয়র খালিদ হোসেন ইয়াদ বলেন, ‘প্রবাসীরা এখানকার জীবনমান সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু ডিভোর্সের হার বেড়েছে। বৈধ কাগজ না থাকায় দেশে আসতে পারেন না অনেকে। মোবাইলে বিয়ে করেন, টাকা পাঠিয়ে দেন। একাকিত্ব থেকে অনেক নারী ডিভোর্সের আবেদন করেন।’
রাজৈর উপজেলার শাখারপাড় এলাকার ইমন মোল্লা গত এপ্রিলে লিবিয়া যান। দুই মাস পর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হন ২১ বছরের এই তরুণ। ছেলে ইমনের অপেক্ষায় থাকা মা আকলিমা বেগম বলেন, ‘কেউ ইমনের লাশ তো দেখে নাই। কেউ কেউ বলে ইমন সাগরে পড়ে গেছে, আবার কেউ বলে ইমন বেঁচেও ফিরতে পারে।’
সদর উপজেলার মস্তফাপুরের ২৪ বছর বয়সী মীর রাকিবুল ইসলাম বর্তমান লিবিয়ার এক কারাগারে বন্দী। গত ১ অক্টোবরে আরও কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে একটি মাফিয়া চক্রের হাতে আটক হন তিনি। তাঁর বাবা এসকেন্দার মীর বলেন, আট লাখ টাকা দিয়ে পাঠিয়েছেন ছেলেকে। মুক্তির জন্য আরও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেছেন দালালেরা। তিনি বলেন, ছেলেকে এই পথে না পাঠানোই ভালো ছিল।
ইমন মোল্লা, মীর রাকিবুলসহ প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লেখ করা নিখোঁজ দুই তরুণ তরিকুল ও রুবেলের স্বজনদের অপেক্ষা কবে ফুরোবে, তা বলতে পারছেন না কেউ।