নোয়াখালী জিলা স্কুলের গল্প

নোয়াখালী জিলা স্কুল মাঠ। ছবি: নোয়াখালী জিলা স্কুলের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
নোয়াখালী জিলা স্কুল মাঠ। ছবি: নোয়াখালী জিলা স্কুলের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

বৃহত্তর নোয়াখালীর শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে এখনো বেশ পরিচিত নোয়াখালী জিলা স্কুল। ১৮৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে ২০২০ সালে এসে পূর্ণ করেছে প্রতিষ্ঠার ১৭০ তম বছর। এই ১৭০ বছরের মধ্যে লুকিয়ে আছে কত শত গল্প!

জিলা স্কুলের ইতিহাসও বেশ চমকপ্রদ। নোয়াখালীর গত ২০০ বছরের ইতিহাস হচ্ছে ভাঙাগড়ার ইতিহাস। সেই সঙ্গে নোয়াখালী জিলা স্কুলের ইতিহাসও ভাঙাগড়ার ইতিহাস বলা যায়। ১৯৪৮ সালের আগ পর্যন্ত বহুবার মেঘনার অতলে ঠাঁই নিয়েছে জিলা স্কুল। ১৮৫০ সালে বেসরকারি উদ্যোগে আয়ারল্যান্ডের সরকারি কর্মচারী নি. জোনস নোয়াখালী জেলার পুরোনো শহরে (সুধারাম) জিলা স্কুল নির্মাণ করেন।

প্রথম তিন বছর বেসরকারিভাবে স্কুলের কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৮৫৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার স্কুলটিকে সরকারি করে নেয়। ১৮ শতকে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের বেশ কিছু জেলায় সরকারিভাবে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে। এগুলোর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬টি ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১১টি জিলা স্কুল রয়েছে। এর মধ্যে নোয়াখালী জিলা স্কুল অন্যতম।

স্কুল করিডর। ছবি: নোয়াখালী জিলা স্কুলের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

সময়ের চাকায় চড়ে ঠিক ১০০ বছর আগে একটু ঘুরে আসা যাক। জেলার সর্বদক্ষিণের রেলস্টেশন সোনাপুরের মাইলখানেক দক্ষিণে ছিল তখনকার নোয়াখালী জেলা সদর সুধারাম। সেখানেই অবস্থিত ছিল নোয়াখালী জিলা স্কুল।
১৯২০ সালে নদীভাঙানের ফলে নোয়াখালীর পুরোনো শহর সুধারামের সঙ্গে নোয়াখালী জিলা স্কুলও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। জেলা সদর সুধারামের মতো তখনকার জিলা স্কুলও ছিল ঐতিহ্যের, ইতিহাসের এবং সর্বোপরি গর্বেরও। এখন তা ঠাঁই নিয়েছে স্মৃতির পাতায়।

নদীভাঙনের ফলে জেলার মতো জিলা স্কুলও বারবার স্থান বদলিয়েছে, যার ফলে নোয়াখালী জিলা স্কুলের প্রথম ১০০ বছরের নথিগুলো মিশে আছে মেঘনার বুকে। নোয়াখালী জিলা স্কুলের শত ইতিহাস এখনো নিজের গর্ভে রেখে দিয়েছে রাক্ষুসি মেঘনা।

১৯২১ সালে সোনাপুরের দক্ষিণে মহব্বতপুর গ্রামের পূর্ব প্রান্তে মন্তিয়ার ঘোনায় নোয়াখালী জিলা স্কুল স্থানান্তরিত করা হয়। নতুন জায়গায় এবার দুই বছরের বেশি টিকতে পারেনি। সেই নদীভাঙনের ফলে আবারও জিলা স্কুল নদীগর্ভে তলিয়ে যায়।

এরপর ১৯২৩ সালের ১ জানুয়ারি জিলা স্কুলকে আরকে জুবলী স্কুলে স্থানান্তরিত করা হয়। আরকে জুবলী স্কুলের মজার একটি ইতিহাস রয়েছে। রায় রাজকুমার দত্ত বাহাদুর স্কুলটি ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। তখন স্কুলের ছাউনি ছিল টিনের তৈরি। স্কুলে দুই ছাত্র বজ্রাঘাতে মারা গেলে তিনি স্কুলটি পাকা দালান করে দেন। ১৯২৩ সালে জিলা স্কুল এখানে স্থানান্তরিত হলে নতুন স্কুলের নামকরণ করা হয় আর কে জিলা স্কুল।

প্রায় আট বছর জিলা স্কুল এভাবে চলার পর আবারও নদীভাঙনের শিকার হয়। এরপর ১৯৩১ সালে জিলা স্কুল চলে আসে আহম্মদিয়া মাদ্রাসার প্রভাতি শাখায়। আহম্মদিয়া মাদ্রাসার প্রভাতি শাখায় চলাকালীন আবারও নদীভাঙনের কারণে জিলা স্কুলকে বঙ্গবিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত করা হয়।

নোয়াখালী জিলা স্কুল মাঠ। ছবি: নোয়াখালী জিলা স্কুলের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

বঙ্গবিদ্যালয়ের ইতিহাসও চমকপ্রদ। ধারণা করা হয় বঙ্গবিদ্যালয় হচ্ছে নোয়াখালীর প্রথম স্কুল। প্রসন্ন মহাজন স্কুলটির জন্য ভূমি দান করেন। শুরুতে স্কুলটির নাম ছিল ইন্দ্রচন্দ্র মধ্য ইংরেজি স্কুল। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবিদ্যালয় নোয়াখালী হাইস্কুলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে। বঙ্গবিদ্যালয়ে বেশ কিছু বছর চলার পর ১৯৪৮ সালে আরেকবার নদীভাঙনের ফলে জিলা স্কুল চলে আসে কেরামতিয়া মাদ্রাসায়।

১৯৫৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর চলতে থাকে এভাবে। একই বছরের শেষ দিকে জিলা স্কুলকে নিয়ে আসা হয় বর্তমান স্থানে। এরপর আর নদীভাঙনের কবলে পড়েনি জিলা স্কুল।

ভাঙাগড়ার ইতিহাস কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। এবার আর নদীভাঙনে নয়, ১৯৫৮ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে জিলা স্কুল বিধ্বস্ত হয়। এর ১২ বছর পর ১৯৭০ সালে আবারও প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে জিলা স্কুল সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। পরবর্তী সময়ে একই স্থানে আবার নতুনভাবে গড়ে তোলা হয় স্কুলটি। বর্তমানে নোয়াখালীর প্রাণকেন্দ্র মাইজদী শহরের ঠিক মধ্যখানে প্রায় আট একর জমিজুড়ে অবস্থান করছে ঐতিহ্যবাহী নোয়াখালী জিলা স্কুল।

নোয়াখালীর প্রতিটি ছেলের স্বপ্নে ঘিরে আছে জিলা স্কুল নামটি। এই অঞ্চলের প্রায় সব মা-বাবা চান তাঁর ছেলেটি জিলা স্কুলে পড়বে। প্রতিযোগিতার ভিড়ে অল্প কজন ভাগ্যবান এখানে পড়ার সুযোগ পায়।

নোয়াখালী জিলা স্কুল মাঠে স্কাউট দল। ছবি: নোয়াখালী জিলা স্কুলের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

এই স্কুলের অনেক ছাত্র দেশের জন্য নানা ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছেন। অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ মোজাফফর আহমদ, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক, শিল্পোদ্যোক্তা আবদুল মান্নান, রাজনীতিবিদ মুজফ্ফর আহমেদের মতো আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি নোয়াখালী জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন।

এবারের এসএসসি পরীক্ষায়ও জিলা স্কুল নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে। কুমিল্লা বোর্ড থেকে ২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় স্কুলটির মোট ৩১২ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছে যাদের মধ্যে পাস করেছে ৩১১ জন। পাসের হার ৯৯.৬৮ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৮৮ জন। যথারীতি ধরে রেখেছে জেলার শীর্ষস্থান এবং কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে ৫ম স্থান।

এসএসসি-২০২০ ব্যাচ বেরিয়ে গেল। এভাবে আর কত ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বিদায় নিয়েছে প্রিয় এই আঙিনা থেকে। প্রতিবছর একদল বিদায় নেয়, অন্যদিকে আরেক দলের আগমনে ভরে ওঠে স্কুলের বিশাল মাঠটি। কেউ আসবে কেউবা যাবে, এইতো জীবনের খেলা। কিন্তু জিলা স্কুল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে আরও শতাব্দী পেরিয়ে হাজার বছর ধরে।

হাজারো ছেলের স্কুলজীবনের স্মৃতির সাক্ষী হয়ে থাকবে শতবর্ষী বটগাছটি, বিশাল পুকুরটি, দালানগুলো, বিশাল মাঠটি। সাক্ষী হয়ে থাকবে স্কুলের পুরো আঙিনা।

নোয়াখালী জিলা স্কুল বেঁচে থাকুক আজীবন। যেন আরও হাজারো ছেলে গর্ব করে বলে যেতে পারে আমিও নোয়াখালী জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমরা NZSIAN, আমরা নোজিস্কুইয়ান।

*তথ্যসূত্র: নোয়াখালীর সেকাল একাল ও বৃহত্তর নোয়াখালীর ৪০০ বছর।
*এইচএসসি পরীক্ষার্থী, নোয়াখালী সরকারি কলেজ। নোয়াখালী জিলা স্কুল ব্যাচ-২০১৮।