নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভেতরে পেছনের সারির একটি বেঞ্চে বসে আছেন নিহত ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও তাঁর বাবা শহিদুল ইসলাম। আদালতের কার্যক্রম তখনো শুরু হয়নি। বাবা-মেয়ে কথা বলছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁদের ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ালেন পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ও সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের ভাতিজা শাহজালাল বাদলসহ চারজন। মুহূর্তেই সেলিনা ইসলাম চুপ করে গেলেন।
সেলিনা ইসলাম পেছনের ওই চারজনকে দেখিয়ে আদালতকক্ষে থাকা এই প্রতিনিধিকে বললেন, ‘দেখেন কী অবস্থা! এরা সব সময় আমাকে ফলো (অনুসরণ) করে। কোথায় যাচ্ছি, কী করছি—সব। মামলার ধার্য দিনে আদালতের চারপাশে পাহারা বসায়। ভয়ে আমার পরিবারের বাইরের আর কেউ আসে না।’ তিনি বলেন, ‘আমি না হয় স্বামী হত্যার বিচারের জন্য আসি, সাক্ষীরা এই অবস্থায় কেন আসবে?’
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের মামলায় গতকাল সোমবার ৩৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের প্রায় দুই বছর পর মামলার বিচার শুরু হলো। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় তাঁর স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ফতুল্লা থানায় মামলা করেন। এ ছাড়া নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল আরেকটি মামলা করেন। ওই দুটি মামলার তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন, র্যা বের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
১৩ মামলার আসামি নূর হোসেন এই মামলায় বিচারের মুখোমুখি হলেও ইতিমধ্যে তিনি একটি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। একটি মামলায় বাদীর সঙ্গে তিনি আপস করে ফেলেছেন। গতকালই আরও তিনটি মামলায় জামিন পেয়েছেন।
সাত খুনের পর নূর হোসেনকে ধরতে পুলিশ তাঁর বাড়িতে দফায় দফায় অভিযান চালায়। বাড়ি থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করে। নূর হোসেন ও পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়। অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ডসহ তাঁর সব অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ। সিদ্ধিরগঞ্জের মানুষ নূর হোসেনের কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়। তাঁর ঘনিষ্ঠ সবাই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ভারতে গিয়ে সে দেশের পুলিশের হাতে ধরা পড়েন নূর হোসেন। কিন্তু তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর আস্তে আস্তে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। আলোচিত এই মামলার মূল আসামি হলেও তাঁকে এক দিনের জন্যও রিমান্ডে নেওয়া হয়নি। পরিস্থিতি অনুকূল দেখে তাঁর সহযোগীরাও এলাকায় ফিরে আসেন।
অভিযোগ গঠন শেষে আদালতের বাইরে এলে সেলিনা ইসলামের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খানের সঙ্গেও কথা বলে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ভারত থেকে দেশে আসার পরে পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো থেকে তিনি অব্যাহতি পেতে শুরু করেছেন। এ অবস্থায় সাত খুন মামলার বাদী আদৌ ন্যায়বিচার পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
অভিযোগ গঠনের জন্য গতকাল র্যা বের সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (অব্যাহতি) মাসুদ রানা ও নূর হোসেনসহ গ্রেপ্তার হওয়া ২৩ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এসব আসামিকে আদালতে আনার নিরাপত্তা প্রস্তুতি হিসেবে গতকাল সকাল থেকেই আদালতের চারপাশের সব ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিচয় নিশ্চিত হওয়া ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তবে বাইরের নিরাপত্তা নিয়ে কড়াকড়ি থাকলেও নূর হোসেনকে তাঁর স্বজন ও সহযোগীদের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলতে দেখা গেছে। শুনানির সময় আদালত ভবনের বাইরেও অনেক লোক অপেক্ষা করছিলেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের সদস্যরা জানিয়েছেন, এঁরা নূর হোসেনের লোকজন। প্রতিবার মামলার ধার্য দিনে তাঁরা আদালতের সামনে এসে জটলা করেন। নূর হোসেনের ভাতিজা শাহজালাল বাদল, ভাই নুরুজ্জামান (জজ মিয়া), নুরুদ্দিন ও নূর হোসেনের ছোট বোনের স্বামী শাহ আলম এদের জড়ো করেন। যতক্ষণ নূর হোসেন আদালতে থাকেন, ততক্ষণ তাঁরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এঁদের ভয়ে নজরুল ছাড়া নিহত অন্য কারও পরিবারের সদস্যরা আদালতে আসতে সাহস করেন না।
পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নূর হোসেন কোন রাস্তা দিয়ে আদালতে আসছেন, তা আগেই তাঁর দলের লোকেরা জেনে যান। সর্বশেষ গত ২৭ ডিসেম্বর তাঁকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে নারায়ণগঞ্জে আনা হয়েছিল ঢাকা-সিলেট সড়কের ভুলতা দিয়ে। সেদিন নূর হোসেনের লোকজন শিমরাইল এলাকায় জড়ো হয়ে নূর হোসেনকে স্বাগত জানান। আসামি বহন করা গাড়ি এ সময় খুব ধীরগতিতে ওই পথ অতিক্রম করে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।
নূর হোসেনের আসার খবর কী করে তাঁর লোকজন আগে জানতে পারেন—এ প্রশ্ন করা হলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি এস এম ওয়াজেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা আমি জানি না। যদি এ রকম হয়ে থাকে, তাহলে অবশই কারা প্রশাসনকে বলব যাতে তারা ব্যবস্থা নেয়।’
নারায়ণগঞ্জ আদালতের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পলাতক থাকার সময় নূর হোসেনের বিরুদ্ধে মোট ১৩টি মামলা ছিল। কিন্তু তিনি দেশে আসার পর এসব মামলা থেকে রেহাই পেতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে সদর থানার টিপু সুলতান হত্যা মামলা থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছে পুলিশ। নূর হোসেনসহ সাতজনের বিরুদ্ধে ওই মামলাটি করা হয়েছিল। সম্প্রতি নূর হোসেনকে বাদ দিয়েই ওই মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।
মামলার বাদী কাজী আক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ আমাকে কিছু না বলেই নূর হোসেনের নাম বাদ দিয়েছে। এখন মামলার আসামিরা আমাকে হুমকি দিচ্ছে।’
আদালত সূত্র জানায়, নূর হোসেন ও তাঁর ভাতিজা শাহজালালের বিরুদ্ধে এক অটোরিকশাচালকের দায়ের করা চাঁদাবাজি মামলায় আপস করা হয়েছে। গত ১০ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম মহিউদ্দিনের আদালতে মামলার শুনানির সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী খোকন সাহা আদালতকে আপসরফার তথ্য জানান। আদালতের নির্দেশে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ২০১৪ সালের ১২ জুন সাইদুল ইসলাম নামে এক অটোরিকশাচালক নূর হোসেন ও তাঁর ভাতিজা শাহজালাল বাদলসহ আটজনের বিরুদ্ধে এই চাঁদাবাজির মামলা করেন।
সর্বশেষ গতকাল মাদক ও অস্ত্র আইনে করা আরও দুটি মামলা থেকে জামিন পেয়েছেন নূর হোসেন। সাত খুনের ঘটনার পর পলাতক থাকার সময় নূর হোসেনের বাড়িতে তল্লাশি করে পুলিশ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করেছিল। ওই ঘটনায় মামলা দুটি দায়ের করা হয়েছিল।
নিহত নজরুলের স্ত্রীর মতো নারায়ণগঞ্জ আদালতের অনেকেই বলেছেন, নূর হোসেনের আইনজীবী খোকন সাহা নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আবার মেজর আরিফের আইনজীবী আবদুর রসিদ আড়াইহাজার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অন্য আইনজীবীরা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে আদালতপাড়ায় সাত খুনের মামলায় কী ঘটে, তা নিয়ে ঔৎসুক্য আছে।
সব আসামির পক্ষে কেন ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত আইনজীবীরা—এ প্রশ্ন করা হলে নূর হোসেনের আইনজীবী খোকন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যেকোনো দল করতে পারি, এর সঙ্গে আমার পেশা কোনোভাবেই যুক্ত হতে পারে না। পেশাটি পেশাদারির দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা উচিত।’ নূর হোসেনের লোকজন আদালতে পাহারা বসিয়ে রাখার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা নূর হোসেনকেই জিজ্ঞাসা করেন।’
নিহত নজরুলের স্ত্রী আক্ষেপ করে বলেন, ‘পুলিশের অভিযোগপত্রের ব্যাপারে আমি নারাজি দেওয়ার পর আমার বাড়ি থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, ফোন নম্বর রাখেন, কিছু হলে ফোন দিয়েন। আমি কি মরার পর তাঁদের ফোন দিব?’