নদীতে ভাসছে এক স্টিমার। আছে কিছু ছোট নৌকা। ঘাটে অপেক্ষারত কিছু লোক। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী গ্রন্থে ১৯১৭ সালের বুড়িগঙ্গা তীরের ওয়াইজঘাটের এই ছবি পাওয়া গেল। নীলকর ওয়াইজের নামে বুড়িগঙ্গাতীরের এই ঘাটের নাম ওয়াইজঘাট। উনিশ শতকে অবশ্য ঢাকা শহরে তিনজন ওয়াইজ পরিচিত ছিলেন। একজন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ, একজন সিভিল সার্জন এবং একজন নীলকর। পূর্ববঙ্গে নীলকর ওয়াইজের বিস্তৃত জমিদারি ছিল। ১৭৭৭ সালে বাংলায় তথা ঢাকায় প্রথম নীল চাষ শুরু হয়। ঢাকার নীলক্ষেত এলাকার বিরাট প্রান্তরজুড়ে নীল চাষ করা হতো। আজও নীলক্ষেতের নামের সঙ্গে নীল শব্দটি জড়িয়ে আছে। ১৮৩০ সালে সরকারিভাবে আইন জারি করে বাংলার তথা ঢাকার কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করা হয়। এতে নীলকরেরা আরও শক্তিশালী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নীল চাষ করতে না চাইলে কৃষকদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালানো হতো। ১৮৪৭ সালের দিকে ঢাকায় ৩৭টি নীলকুঠি ছিল। সবচেয়ে নামকরা নীলকর ছিলেন ওয়াইজ। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনে নীলকর ওয়াইজের প্রভাব ছিল ব্যাপক। সবাই তাঁকে একনামে চিনত। নীল চাষের মাধ্যমে একজন সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে ধনাঢ্য বণিকে পরিণত হন ওয়াইজ। তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার মতো শক্তি ও সাহস তখন কারও ছিল না। তাঁর প্রভাব এত বেশি ছিল যে সাধারণ জনগণ তাঁকেই সরকার বাহাদুর মনে করত। এই ওয়াইজের পৃষ্ঠপোষকতায় সে সময় ঢাকা নিউজ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করা হতো। পত্রিকাটি ইংরেজ সরকারের মুখপত্র হিসেবে কাজ করত। ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ঢাকা কোষ-এ বলা হয়েছে, ১৮৪০ সালে প্রকাশিত প্যানোরমা অব ঢাকার দৃশ্যে বুড়িগঙ্গার তীরে ওয়াইজের বাড়ি এবং সিঁড়িযুক্ত একটি নদীর ঘাট দেখা যায়।
ওয়াইজের বাড়ির পাশে নদীর ঘাটে বড় নৌকা ও বজরা বাঁধা থাকত বলে একসময় এই ঘাট ওয়াইজ ঘাট নামে পরিচিতি পায়। ১৮৫১ সালে নীলকর ওয়াইজ ভাওয়াল রাজা কালী নারায়ণের কাছে তাঁর জমিদারি বিক্রি করে ইংল্যান্ডে চলে যান। তবে তাঁর বাড়ির পাশের ঘাটটি এখনো ওয়াইজঘাট নামেই রয়ে গেছে। ওয়াইজঘাট এখন বুড়িগঙ্গার ব্যস্ততম একটি ঘাট। দক্ষিণবঙ্গের বহু লোক প্রতিদিন এই ঘাট ব্যবহার করে। এ ছাড়া নদীতে ভ্রমণের জন্যও এখানে রয়েছে নৌকার ব্যবস্থা। কেউ চাইলেই এখানে এসে বেড়িয়ে যেতে পারেন।
লেখা: শরিফুল হাসান। ছবি: হাসান রাজা