সড়ক দুর্ঘটনা

নিহতদের ৪০% মোটরসাইকেল আরোহী

  • সর্বশেষ গত জুনে ৪৬৭টি দুর্ঘটনায় ৫২৪ জন নিহত হন। এর মধ্যে ১৯৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ২০৪ জন।

  • গত জুন পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ১৩৮।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন—এ ৬ মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা গেছেন, তার প্রায় ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। এ অবস্থায় মহাসড়কে বেপরোয়া মোটরসাইকেলের চলাচল নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন উদ্বোধন করা পদ্মা সেতু দিয়ে সাময়িকভাবে মোটরসাইকেল চালানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন সিদ্ধান্ত সরকারের দ্বিমুখী নীতির বহিঃপ্রকাশ। সহজলভ্য করে ও চলাচলকে উৎসাহ দিয়ে দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ানো হলেও তা চলার উপযুক্ত সড়ক করে দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া খুব সহজেই মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ৬ মাসে দেশে সড়ক–মহাসড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৩০৯ জন।

বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশন প্রতি মাসেই সড়ক দুর্ঘটনার বিস্তারিত তথ্য দিয়ে থাকে। তাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ৬ মাসে দেশে সড়ক–মহাসড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৩০৯ জন। যাঁদের মধ্যে নিহত মোটরসাইকেলচালক বা আরোহীর সংখ্যা ১ হাজার ৩১৩। অর্থাৎ মোট নিহত ব্যক্তির ৩৯ দশমিক ৬৭ শতাংশই মোটরসাইকেলের চালক–আরোহী। ছয় মাসের এ গড় হিসাবের বাইরেও প্রতি মাসেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই থাকছেন মোটরসাইকেলের আরোহী।

রোড সেফটি নয়টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

এই ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বশেষ গত জুন মাসে ৪৬৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫২৪ জন নিহত ও ৮২১ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ২০৪ জন, যা নিহত ব্যক্তিদের মোট সংখ্যার ৩৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। জুনে সড়ক–মহাসড়কের মধ্যে আঞ্চলিক সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি; ৩৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আঞ্চলিক সড়কের উন্নয়ন হয়েছে। যানবাহনের সংখ্যাও বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে মোটরসাইকেল। এ ছাড়া আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়ক ঘেঁষেই মানুষের বসবাস। তাই আঞ্চলিক সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে। সড়কে দুর্ঘটনার নানা কারণের মধ্যে যানবাহনের সংশ্লিষ্টতা ও যানবাহনের সংখ্যার হিসাবেও মোটরসাইকেল রয়েছে শীর্ষে। গত ৬ মাসে দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যানবাহন হিসাব করলে এর মধ্যে গড়ে ২৬ শতাংশের ওপরে ছিল মোটরসাইকেল। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে এ বছরের জুন পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ১৩৮।

গত ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয়েছে পদ্মা সেতু। পরদিন থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে সেদিন পুরো সেতু এলাকায় ছিল মোটরসাইকেলের রাজত্ব। রাতে সেতুতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় চালক ও আরোহী মারা যান। এর পরের দিন (২৭ জুন) থেকে সরকার এই সেতুতে মোটরসাইকেলের চলাচল সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করে। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, আসন্ন ঈদের আগে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালুর সম্ভাবনা নেই। সেতুতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্যামেরা, স্পিডগান বসানো হলে সরকার মোটরসাইকেলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়া ও বর্তমানে তা মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠার পেছনে আছে নীতিগত দুর্বলতা। সরকার এখন মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পন্থার কথা বলছে। কিন্তু রিকশা ও থ্রি–হুইলারের বেলাতেও সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। মোটরসাইকেলেও এটি সহজে সম্ভব নয়।

মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘সরকার মোটরসাইকেলকে সহজলভ্য করেছে, উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু মোটরসাইকেল চলার উপযুক্ত সড়ক করেনি, আলাদা লেন করেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এই মোটরসাইকেল এখন যাতায়াতব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হয়েছে ও জীবিকার পথ তৈরি করেছে। চাইলেই একে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। দক্ষ চালক ও মোটরসাইকেলের চলাচল উপযোগী সড়ক আগে করতে হবে।’

এদিকে জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকা বিভাগে; ১১৭টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৩৯ জন। সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ছিল কম। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, রেল ও নৌপথের উন্নয়ন, ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে।