নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া শুরু, আশা ও উদ্বেগ দুই-ই আছে

>পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কাউকে সরে যেতে হবে না। পাহাড়িরা যেমন তাদের জমি-বাড়ি ফেরত পাবে, তেমনি বাঙালিরাও থাকার জায়গা পাবে। তবে পাহাড়িদের জায়গাজমি দখল করে কোনো বাঙালি থাকতে পারবে না

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন ওই অঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দুই বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ি জুম্ম জনগণ দীর্ঘদিন পর নিজেদের জমি-বাড়ি ফিরে পাওয়ার আশায় উজ্জীবিত। আর পুনর্বাসিত (সেটেলার) বাঙালিরা প্রায় চার দশকের আবাসস্থল থেকে উচ্ছেদের আতঙ্কে শঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ।

এদিকে ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী অধ্যাদেশ আকারে প্রকাশের পরই কমিশন ৪৫ দিন সময় দিয়ে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করে। ২৬ অক্টোবর এ সময় শেষ হবে। ইতিমধ্যে প্রায় তিন হাজার দরখাস্ত জমা পড়েছে উল্লেখ করে কমিশনের একটি সূত্র জানায়, দরখাস্তগুলো পর্যালোচনা করে সাত-আট ধরনের বিরোধ দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে পাহাড়ি-বাঙালি বিরোধ ছাড়াও সরকারের সঙ্গে পাহাড়িদের, সরকারের সঙ্গে বাঙালিদের, পাহাড়িদের সঙ্গে পাহাড়িদের, বাঙালিদের সঙ্গে বাঙালিদের, ভূমি বন্দোবস্ত পাওয়া ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে পাহাড়িদের, বন্দোবস্ত পাওয়াদের সঙ্গে বাঙালিদের ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার জামতলি নোয়াপাড়ার ভারত প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থী পুনর্বাসন এলাকার বিমলেন্দু চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে ভারতে শরণার্থী হয়েছিলেন। এখানে ফিরেও শরণার্থী হয়েই আছেন। নিজের জমি-বাড়ি বেদখল হওয়ার বিষয়ে ভূমি কমিশনে দরখাস্ত করেছেন। কমিশন যদি তা ফিরিয়ে দেয়, তাহলেই এই অবস্থার অবসান হতে পারে।
ওই পাড়ার নিরণ চাকমা বলেন, প্রায় ১৯ বছর নিজের দেশে উদ্বাস্তু অবস্থায় আছেন। জায়গা-বাড়ি অন্যের দখলে। নিজের জমিতে চাষাবাদও করতে পারছেন না। তাঁর বাড়িতে অন্য একজনকে বসিয়ে দিয়ে তাঁকে উদ্বাস্তু করে দেওয়া কেমন বিচার? এই অন্যায়ের অবসান হওয়া দরকার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক (বর্তমানে প্রবাসী) আদিত্য কুমার দেওয়ানের বাড়ি রাঙামাটির বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়নের ভূষণবাগ গ্রামে। ১৯৮০-৮১ সালে তাঁদের জমিতে পুনর্বাসিতদের বসানো হয়। তারপরও আদিত্য কুমারের দুই ভাই ও তাঁদের পরিবার বাড়িতে টিকে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু ১৯৮৪ সালে ভূষণছড়ায় পুনর্বাসিত বাঙালিরা এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এরপর থেকে ওই পরিবার বাড়িছাড়া।
ভূষণছড়া এলাকাটি ১৫৮ নম্বর মাউদং মৌজাভুক্ত। ওই মৌজার বর্তমান হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) দীপন দেওয়ানও ওই বাড়িছাড়া পরিবারের সদস্য। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বর্তমানে তাঁদের জায়গায় ৩০টি পুনর্বাসিত বাঙালি পরিবার আছে। ওই এলাকায় ২০০৭-০৮ সালেও জুম্মদের জমি দখল করা হয়েছে। ওই মৌজার দুজন কারবারি (পাড়াপ্রধান) বিজু কুমার ও নতুন চাকমা জমি-বাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু। ভূমি কমিশন আইন সংশোধিত হওয়ায় এখন তাঁরা বাড়িঘর ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছেন। কমিশনে অবেদন করছেন বিরোধ নিষ্পত্তির।
অন্যদিকে, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভুয়াছড়ি গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা পুনর্বাসিত বাঙালিরা শঙ্কিত। সেখানকার এক বাসিন্দা রিজিয়া বেগম বলেন, ‘১৯৮১-৮২ সালে পাহাড়ে আসছি। কত যুদ্ধ, মারামারি আমাগো ওপর দিয়া গেছে। এখন শুনি আমাদের যে জমি দেওয়া হইছিল, তা আবার পাহাড়িদের ফেরত দেওয়া হবে। তাইলে আমরা যাব কোথায়?’
ওই গুচ্ছগ্রামের ইদ্রিস আলী হাওলাদার বলেন, সরকারই তাঁদের এখানে নিয়ে এসেছে। থাকতে দিয়েছে। এখানে বসবাস করছেন প্রায় ৩৭ বছর ধরে। এখন চলে যেতে বললে তাঁরা যাবেন কোথায়? এভাবে হাজার হাজার পরিবার যাতে আবার কোনো সংকটে না পড়ে, সেটা দেখার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।
এই দ্বন্দ্বের নিরসন কীভাবে হতে পারে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজন এবং ঢাকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের নির্ভরযোগ্য সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কাউকে সরে যেতে হবে না। পাহাড়িরা যেমন তাদের জমি-বাড়ি ফেরত পাবে, তেমনি বাঙালিরাও থাকার জায়গা পাবে। তবে পাহাড়িদের জায়গাজমি দখল করে কোনো বাঙালি থাকতে পারবে না।
তাহলে কি সরকার বাঙালিদের নতুন করে জায়গা দেবে? এই প্রশ্নের জবাবে সূত্রগুলো জানায়, সরকার যাদের পুনর্বাসন করেছিল, তাদের দায়িত্ব নেওয়ার একটি নৈতিক দায় আছে সরকারের। এ ছাড়া পুনর্বাসিত বাঙালিদের অনেকেই এত দিনে জায়গা কিনে নিজেদের আবাস করে নিয়েছে। এর বাইরেও যদি কেউ থাকে, তার বিষয়েও সরকার ভাববে।
বিষয়টি সম্পর্কে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও গুইমারা উপজেলার ২১২ নম্বর বরইতলী মৌজার হেডম্যান কংজ্যরি চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মৌজায় ১৪৭টি পুনর্বাসিত বাঙালি পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে চার-পাঁচটি পরিবারের। অন্যরা যে জায়গায় বসবাস করছে, তা কোনো ব্যক্তির জায়গা নয়। যাদের জায়গা নিয়ে কারও সঙ্গে বিরোধ নেই, তারা সেই স্থানেই থাকবে। এমনকি তাদের ভূমি কমিশনে আসারও দরকার হবে না।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত বাঙালিদের স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যাপারে আপত্তি আছে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস)। ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনকে জেএসএস আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। তবে দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজটি যতটা সহজ ভাবা হচ্ছে, ততটা সহজ না-ও হতে পারে। এর একটা বড় কারণ বাঙালিদের সেখানে স্থায়ীভাবে অবস্থান করার বিষয়টি।
জেএসএস সূত্রের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে খাসজমি বলতে কিছু নেই। সেখানে যে জমি কোনো ব্যক্তির নয়, তা হলো মৌজা জমি। মৌজাপ্রধানের ওপর দায়িত্ব থাকে সেই জমি ব্যবস্থাপনার। পুনর্বাসিত বাঙালিদের অনেকে এসব জমিতে অবস্থান করছে। সরকার যেসব পুনর্বাসিত বাঙালিকে কবুলিয়ত দিয়েছিল, তাদের অনেকেই সেই কবুলিয়ত বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছে। এরপর আরও বেশিসংখ্যক বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে। তারা মৌজা জমিতে অবস্থান নিয়েছে। তারা আসার আগে তো এসব জমি পাহাড়িরাই ব্যবহার করত। কাজেই সেসব জমিতে বাঙালিদের বসবাসের সুযোগ দিয়ে বিষয়টির মীমাংসা করা খুব সহজ হবে না।
ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ার আরও কিছু দুর্বল দিক বিদ্যমান বলে প্রথম আলোকে বলেছেন কয়েকজন আইনজীবী। রাঙামাটির প্রবীণ ও বিশিষ্ট আইনজীবী জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা বলেন, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন-সংক্রান্ত টাস্কফোর্স এখন পর্যন্ত প্রত্যাগত শরণার্থী ও উদ্বাস্তুদের তালিকা চূড়ান্ত করতে পারেনি। তাহলে কমিশন এদের বিষয়ে কাজ করবে কীভাবে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয়তা এদের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে জরুরি। কারণ তারা নিজেদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে কার্যত শরণার্থীর জীবনই যাপন করছে।
আইনজীবী প্রতিম রায় বলেন, বিধিমালা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কোনো আইনের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কাজেই ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করা হলেও এর বিধিমালা এখনো তৈরি হয়নি। তা ছাড়া, কমিশনের রায় বাস্তবায়নের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ভূমি কমিশনের রায় মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন কে করবে তা-ও স্পষ্ট নয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যাগত শরণার্থীর তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। মোট ১২ হাজার ২২২টি পরিবার প্রত্যাগত শরণার্থী। লোকসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। তবে আরও কিছু পরিবার প্রত্যাগত শরণার্থী হিসেবে দাবি করছে। কিন্তু তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আগেই বিভিন্ন সময়ে স্বেচ্ছায় দেশে চলে এসেছে। তাই তাদের এই তালিকাভুক্ত করা হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত টাস্কফোর্স নিতে পারবে না। সরকারকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য উপজেলাভিত্তিক কমিটি করে কাজ করা হচ্ছে। শিগগিরই এ তালিকাও চূড়ান্ত করা যাবে। এখন পর্যন্ত কাজের ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে, এটা ৫০ হাজার পরিবারের মতো হতে পারে। তবে এর মধ্যে কতগুলো পরিবার ভূমি বিরোধের কারণে নিজের বাড়িঘরে যেতে পারেনি তা নিশ্চিত নয়। ভূমি কমিশনে আবেদন করলেই এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
ভূমি কমিশন আইন সংশোধন ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি প্রসঙ্গে অভিমত জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, এটি অবশ্যই সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ। পার্বত্য চট্টগ্রাম পুরোপুরিই ভূমিকেন্দ্রিক। তাই এর সমাধান হলে প্রায় সবকিছুই স্বাভাবিক হবে। তবে ভূমি কমিশন আইনটি করা হয়েছিল ২০০১ সালে। তখন থেকেই এর সংশোধনের বিষয়ে কাজ চলেছে। শেষ পর্যন্ত আইনটি সংশোধন হতে ১৫ বছর লেগেছে। যে কারণে আইনের সংশোধনীতে এত বছর লাগল, সে কারণে আইনের বাস্তবায়নও যেন বিলম্বিত বা বিঘ্নিত না হয়, সেটাই পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর চাওয়া।