গত ১০ বছরে পরিবেশ অধিদপ্তর দেশে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে ২২১ কোটি টাকা খরচ করেছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণের অর্থে ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ নামের এ প্রকল্পের (কেইস) মাধ্যমে এই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। তবে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ১২৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে প্রশিক্ষণের নামে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর, পরামর্শক ফি, গাড়ি কেনা ও ভবন নির্মাণে। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয়ে গত জুনে প্রকল্পটি শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশে বায়ুর মান আরও খারাপ হয়েছে।
এ অবস্থায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। প্রকল্পের অধীনে ১০ বছরে ২৯৬ জন কর্মকর্তা বিদেশে প্রশিক্ষণে গেছেন। একজন কর্মকর্তা ১০ বারও বিদেশে গেছেন। কমিটি মনে করছে, প্রকল্পের ব্যয় এর উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। প্রকল্পটি মূল্যায়নের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) পাঠাচ্ছে সংসদীয় কমিটি।
এই প্রকল্পের ১০ বছরে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন একে একে চার মন্ত্রী। শুরুতে ছিলেন বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এরপর জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং এখন আছেন মো. শাহাব উদ্দিন।
আনোয়ার হোসেন গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশি অর্থায়ন–নির্ভর বেশির ভাগ প্রকল্পেই প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফর, পরামর্শক এবং কেনাকাটায় বেশি ব্যয় হয়ে থাকে। এটা মেনে নিয়েই প্রকল্পগুলোর জন্য আমরা অর্থ নেই। এই প্রকল্পেও একই ঘটনা ঘটেছে। এখনো এর ধারাবাহিকতা চলছে।’ এ ব্যাপারে অন্যদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরে বায়ু মান ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (একিউএমপি) নামে আরেকটি প্রকল্প করেছিল। এরপর দুই বছর বিরতি দিয়ে কেইস প্রকল্প শুরু হয়। ওই দুই প্রকল্প শেষ হওয়ার পর সংস্থাটির নিজের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর বায়ুদূষণের সময়কাল আরও বেড়েছে। এমনকি শুধু রাজধানী নয়, দেশের বেশির ভাগ জেলা শহরের বায়ুতে দূষণের মাত্রা নিয়মিতভাবে বাড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের বেশ কটি গবেষণায় দেশের বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে। এমনকি বায়ুদূষণের নিত্যনতুন উৎস তৈরি হচ্ছে বলেও এসব গবেষণায় দেখা গেছে।
>১০ বছরে ২৯৬ জন কর্মকর্তা বিদেশে প্রশিক্ষণে গেছেন
একজন কর্মকর্তা ১০ বারও বিদেশে গেছেন
৭২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ব্যয় ভবন নির্মাণে
প্রকল্পের ১০টি গাড়ির ৫টি অকেজো
প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই প্রকল্পের আওতায় বায়ুদূষণের মাত্রা ও ধরন সম্পর্কে আমরা ধারণা পেয়েছি। কিন্তু দূষণ কমানোর কাজে এসব তথ্য কী কাজে এল, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা, ১০ বছর ধরে আমরা দেখছি ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ শহরের বায়ুদূষণ আরও বেড়েছে। এত দিন বায়ুদূষণ ছিল শুধু ঘরের বাইরে, এখন ঘরের মধ্যে এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কক্ষের মধ্যেও দূষিত বায়ু প্রবেশ করছে।’ বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি।
রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণ বেড়েই চলেছে। পরিবেশ গবেষক আতিক আহসানের একটি চলমান গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৪ সালে বছরে ১৬৫ দিন রাজধানীর বায়ু অস্বাস্থ্যকর থেকে মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর ছিল। ২০১৫ সালে তা বেড়ে ১৭৩ দিন, ২০১৬ সালে ১২৯ দিন, ২০১৭ সালে ১৮৫ দিন ও ২০১৮ সালে ১৯৭ দিন ছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনও বলছে, ঢাকা ছাড়াও গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামে বায়ুদূষণ ক্রমেই বাড়ছে।
এই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মঞ্জুরুল হান্নান খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্প ছিল বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে। প্রকল্পের সব কাজ বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার দেখে। এ ধরনের প্রকল্পে অনিয়ম হওয়ার সুযোগ নেই। বিদেশ সফর নিয়ে তিনি বলেন, প্রশিক্ষণকে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে, এটা কাজেরই অংশ। বায়ুর মান খারাপ হওয়ার বিষয়ে বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমেই প্রথম ধারাবাহিকভাবে দেশে বায়ুর মান পরীক্ষা করার সুযোগ তৈরি হয়। কেন বায়ুর মান খারাপ, সেটা চিহ্নিত হয়েছে। এখন দায়িত্ব হলো, এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া। এটা পরিবেশ অধিদপ্তর একা করতে পারবে না।
অনেক কিছুই হয়নি
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, কেইস প্রকল্পের আওতায় কেনা ১০টি গাড়ির মধ্যে ৫টিই বর্তমানে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। প্রকল্পের আওতায় একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে উন্নত মানের ইট তৈরির প্রযুক্তি হিসেবে ‘ইমপ্রুভড জিকজাক’ কৌশল ব্যবহার করে ইট বানানোর একটি নমুনা স্থাপনের কথা ছিল। প্রতিষ্ঠানটি তা করেনি। সরকারি সংস্থা হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই) থেকে না পুড়িয়ে ইট বানানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কথা ছিল। সরকারি এই সংস্থাও তা করতে পারেনি। প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ১৬টি বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর এখন সেগুলো কীভাবে চলবে, তা নিশ্চিত করা হয়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তর প্রকল্পের যে অংশের কাজ বাস্তবায়ন করেছে, তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়ে সেই অংশের বরাদ্দ ছিল ২৮৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার দিয়েছে ২৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, বাকি অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক। গত জুনে প্রকল্পটি শেষ হয়। প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২২১ কোটি ৪৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী ও খুলনা ছিল এই প্রকল্প বাস্তবায়ন এলাকা।
গত ২৯ জুলাই সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণে ব্যয় হয়েছে ১৫ কোটি ২৩ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। মোট ২৯৬ জন বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণে গেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত একাই ১০ বার বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য গেছেন। তিনি বর্তমানে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (শরণার্থী সেল) হিসেবে কর্মরত।
কেইস প্রকল্পে আট বছর কাজ করে ১০ বার বিদেশে প্রশিক্ষণ, সেমিনারে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রেজওয়ান হায়াত প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব বিদেশ সফর থেকে আমার যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় কী ধরনের বায়ুদূষণ হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি।’
এই প্রকল্পে ৩৪ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছে। এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৩৩ কোটি ৪৫ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে জিয়ান রিসার্চ অ্যান্ড ডিজাইন ইনস্টিটিউট ওয়াল অ্যান্ড রুফ ম্যাটেরিয়ালস নামে চীনের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দুটি গবেষণার কাজ শেষ করেনি। এ প্রকল্পে গাড়ি কেনার জন্য ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ১২ লাখ টাকা। ৭২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে ভবন নির্মাণে। রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় হয়েছে ৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এসব খাতে ব্যয় ও প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংসদীয় কমিটি। কমিটি মনে করে, এখানে অনিয়ম হয়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ ছিল নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ উন্নয়ন। কিন্তু যেভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে, তাতে উদ্দেশ্যের সঙ্গে অসংগতি আছে বলে মনে করে সংসদীয় কমিটি। দেখা গেছে, প্রকল্পের টাকায় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, কয়েক শ ব্যক্তিকে বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে। যাঁদের প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে তাঁদের অনেকে অবসরে গেছেন। প্রচুর সংখ্যক পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত দুটি ক্ষেত্রে পরামর্শক ১০-২০ শতাংশ কাজ করে বাকি কাজ করেনি। রক্ষণাবেক্ষণে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে, তা অনেক বেশি।