দীপন হত্যার দুই বছর আজ

নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী এখনো গ্রেপ্তার হয়নি

ফয়সল আরেফীন দীপন
ফয়সল আরেফীন দীপন

প্রকাশক ও জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সল আরেফীন দীপন হত্যার নির্দেশদাতা, মূল পরিকল্পনাকারী, হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের দুই বছরেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সূত্র বলেছে, এদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে।

আজ ৩১ অক্টোবর দীপন হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা তিনজন কারাগারে রয়েছেন। দীপনের পরিবার বলছে, তারা চায়, যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের অন্তত বিচার হোক।

মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, দীপনকে হত্যার নির্দেশদাতা, মূল পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ছিলেন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (পুরোনো নাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) কথিত সামরিক শাখার প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও দ্বিতীয় প্রধান মো. সেলিম। সেলিমের ছবি ও নাম পেলেও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা এখনো পাওয়া যায়নি। কয়েকজন ব্লগার ও প্রকাশক হত্যায় জড়িত ছয়জনের ছবি পুলিশ গণমাধ্যমে প্রকাশ করে এবং তাঁদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল। পুলিশ সদর দপ্তর সৈয়দ জিয়াউল হককে ধরিয়ে দিতেও পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। জঙ্গি সংগঠনটির প্রধান ও তাত্ত্বিক নেতা মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানী কারাগারে আছেন। রাজধানীর পল্লবীতে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় তাঁর পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর দুপুরের পর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। একই দিন কাছাকাছি সময়ে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে এর স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুল, লেখক সুদীপ কুমার ওরফে রণদীপম বসু ও প্রকৌশলী আবদুর রহমানকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে। এ মামলারও বলতে গেলে একই অবস্থা। এই দুই মামলারই তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, উভয় ঘটনাতেই আনসার আল ইসলাম জড়িত। সংগঠনটির অন্যতম নেতা সেলিমই এ দুই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী। নির্দেশদাতা ছিলেন চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক। সংগঠনে সেলিমের অনেক ছদ্মনাম রয়েছে। তিনি ইকবাল, মামুন ও হাদি-২ নামেও পরিচিত।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, দীপন হত্যা ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিকসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টার মামলায় আট-দশজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ দুই মামলায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে ছয়জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে একেকটি ঘটনায় সাত-আটজন করে জড়িত বলে তথ্য দিয়েছেন। যাঁদের গ্রেপ্তার করা যায়নি তাঁদের পলাতক হিসেবে অভিযোগপত্রভুক্ত করা হবে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দীপন হত্যা মামলায় খায়রুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে ফাহিম ওরফে রিফাত, আবদুস সবুর ওরফে সামাদ ওরফে সুজন ওরফে সাদ, মইনুল হাসান ওরফে শামীম ওরফে সামীরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এঁরা দীপনের হত্যাকারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে যে সাত-আটজনের জড়িত থাকার তথ্য দিয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে।

পুলিশ বলেছে, আহমেদুর রশীদসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টার মামলায় আনসার আল ইসলামের চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন রশিদুন্নবী ভূঁইয়া টিপু, আবদুস সবুর ওরফে সামাদ ওরফে সুজন ওরফে সাদ, মইনুল হাসান ওরফে শামীম ওরফে সামীর ও সুমন পাটোয়ারি। সবুর, সুমন ও রশিদুন্নবী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাঁদের প্রশিক্ষণদাতা শরিফুল ওরফে মুকুল রানা হামলার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। শরিফুল গত বছরের ১৮ জুন রাতে খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ায় ডিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। তিনি ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন।

মামলার বাদী নিহত দীপনের স্ত্রী চিকিৎসক রাজিয়া রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো মূল খুনি ধরা পড়েনি। সে জন্য ধৈর্য ধরে আমরা অপেক্ষা করছি। এর আগে প্রতি মাসেই ডিবি বলেছে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য অভিযোগপত্র দিতে দেরি হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি যে কয়জন গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের অন্তত বিচারটা হোক।’

দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সরকার চাইলে পুলিশ সক্রিয় হয়। সরকারের ভূমিকা না থাকলে কোনো কিছুই এগোয় না। দেড় বছর আগে ডিবি তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছিল, আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ঘটনার বিচার শুরু হবে, এটাই চান তিনি।