নিপাহ ভাইরাসে আতঙ্কিত নয়, দরকার সচেতনতা

খেজুরের রস খাওয়ার লোভে ছোটরা এভাবে গাছে ওঠে পড়ে। প্রথম আলো ফাইল ছবি
খেজুরের রস খাওয়ার লোভে ছোটরা এভাবে গাছে ওঠে পড়ে। প্রথম আলো ফাইল ছবি

শীত ঋতু এলে কার মনে না চায় খেজুরের রস খেতে! গ্রামীণ জনপদ, সংস্কৃতি ও সভ্যতায় খেজুরের রস নিয়ে রয়েছে নানা প্রবাদ ও ধাঁধা। ‘মাইট্যা গোয়াল কাঠের গাই, বাছুর ছাড়া দুধ পাই’। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কখনো গাছির (হেলালুর) চোখ ফাঁকি দিয়ে, পাটখড়ির (টাঙ্গি) স্ট্র নিয়ে রস টেনে খাওয়ার স্মৃতি কে ভুলতে পারবে! এরপর কাকডাকা ভোরে খেজুর রসের মন মাতানো ঘ্রাণের স্মরণে কার না জিহ্বায় পানি আসবে!

কবির ভাষায়, ‘এমন শীতল মিষ্টি কোথা আছে নীর? পান মাত্র তৃষিতের জুড়ায় শরীর’। তাই খেজুরগাছকে অনেকে শখের বসে ‘মধুবৃক্ষ’ বলেন। এই মধুবৃক্ষ থেকে আহূত রস কাঁচা ও জ্বাল দিয়ে খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এ রস দিয়ে তৈরি গুড় ও পাটালিরও তুলনা নেই। তাই বাঙালির শীতের পিঠা-পায়েসের একটি আবশ্যকীয় উপাদেয় উপাদান খেজুরের রস।

শীত পড়বে আর খেজুরগাছ থেকে রস নামাবেন না গাছিরা, তা হতে পারে না। শীতে গাছিরা গাছ থেকে হাঁড়িভর্তি রস নামাচ্ছেন, এ দৃশ্য যেন গ্রাম-বাংলার আবহমান প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে। শীতকালে গ্রামাঞ্চলের সর্বত্রই খেজুর রস, খেজুর গুড় বিক্রি-বাণিজ্যে দারিদ্র্য বিমোচন ছাড়াও বাঙালি সংস্কৃতিতে আতিথেয়তার মৌসুম ও রসঘন আমেজ-উৎসব বিরাজ করে। চোং দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রস জমে একসময় শূন্য হাঁড়ি ভরে যায়। কবি বলেছেন, ‘খালি কলসি রেখে দিলে, ভরে যায় রসে, সেই রসে দিয়ে জ্বাল, মন ভরে সুবাসে’। শুধু ঠান্ডা খেজুরের রস খেয়েই কি মন ভরবে? না! সঙ্গে খেজুর রসের পিঠা-পায়েসও চাই। এ ছাড়া এই রসে তৈরি দানা, ঝোলা, নলেন গুড়ের স্বাদ ও ঘ্রাণই আলাদা। তাফালে (অ্যালুমিনিয়ামের বিশেষ পাত্র) জ্বাল দেওয়া হয় কাঁচা রস। ঘনীভূত সেই রস থেকেই হয় সরেস গুড়। জ্বাল দেওয়া শেষে তপ্ত তরল গুড় ঢালা হয় পাটালির ছাঁচে। খানিক বাদেই তরল গুড় জমাট বেঁধে তৈরি হয় সুস্বাদু পাটালি। এরপর এই পাটালি গুড়ের তৈরি ভাপা পিঠা কী-ই না মজা!

খেজুরের রস ও নানা রকমের পায়েস-পিঠার সঙ্গে বাঙালির সংস্কৃতির সম্পর্ক রয়েছে। রয়েছে রস দিয়ে হরেক রকম পিঠার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। খেজুর পিঠা ও রসের নানা রেসিপি, শিরনি-পায়েস, ঘনরসে চিতই পিঠা, খেজুর গুড়-নারকেল মিশ্রণে বিভিন্ন রন্ধনপ্রণালির সুখ্যাতি শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও ব্যাপক। খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরি করা একটি শিল্প। খেজুরের ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়, ভেলি গুড়, বালুয়া গুড়, মিছরি গুড় বেশ সুস্বাদু ও সুপরিচিত। শিশু-কিশোরদের কোচড়ভরা, কিশোরীদের শরীরের আঁচলে গোঁজা পাটালি গুড় এবং মুড়ি খাওয়া গ্রামের প্রচলিত ও অতিপরিচিত দৃশ্য।

গুড় তৈরি শেষ। প্রথম আলো ফাইল ছবি

এ ছাড়া খেজুরের রস বেশ উপকারী পানিও আমাদের জন্য। এতে জলীয় অংশ বেশি থাকায় খেজুরের রস পানে শরীরে প্রচুর এনার্জি বা শক্তি সঞ্চার হয়ে থাকে। এই রসকে প্রাকৃতিক ‘এনার্জি ড্রিংক’ বলা হয়ে থাকে। খেজুরের রস কাঁচা খাওয়া ছাড়াও জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করেও খাওয়া হয়। গুড়ে আয়রন বা লৌহ বেশি থাকায় হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে। যাঁরা শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন, কাজকর্মে জোর পান না, খেজুরের রস তাঁদের জন্য দারুণ উপকারী হতে পারে। খেজুরের রস প্রচুর গ্লুকোজ, খনিজ ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এতে ১৫-২০ শতাংশ দ্রবীভূত শর্করা থাকে। খেজুরের গুড় আখের গুড় থেকেও বেশি মুখরোচক, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। খেজুরের গুড়ে প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেলে ভরপুর। তবে যাঁদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাঁদের খেজুরের রস ও গুড় এড়িয়ে যাওয়া উচিত।

বাঙালি ঐতিহ্যের ধারক-বাহক সুমিষ্ট, সুস্বাদু এই খেজুরের রসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে নিপাহ ভাইরাস। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা খুব একটা বেশি না হলেও এ ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ব্যাপক। বাংলাদেশে ২০০১ থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত নিপাহ রোগে আক্রান্ত হয়েছে ৩১৩ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ২১৭ জন। দেখা যায়, আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ।

১৯৯৮-৯৯ সালে নিপাহ ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় মালয়েশিয়ার সুঙ্গাই ‘নিপাহ’ নামক গ্রামে। ওই গ্রামের নামেই ভাইরাসটির নামকরণ করা হয়। মূলত ফলাহারি বাদুড় এই ভাইরাসের প্রধান বাহক। তবে গবেষণায় জানা যায়, ফলাহারি বাদুড় নিজে ওই ভাইরাসে আক্রান্ত হয় না। আমাদের দেশে নিপাহতে আক্রান্ত হওয়ার মূল উৎস খেজুরের রস। তবে মালয়েশিয়ায় নিপাহতে মৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ হলেও আমাদের দেশে মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ। এতে প্রমাণিত, আমাদের দেশের নিপাহ ভাইরাস শক্তিশালী।

অ্যানথ্রাক্স, নিপাহ ভাইরাস, ব্রুসেলোসিস, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, ডায়রিয়ার মতো ভয়াবহ রোগগুলো পশুপাখির মাধ্যমে মানবদেহে ছড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী মানুষের দেহে সৃষ্ট ৭০ ভাগ রোগের জীবাণু বহন করে পশুপাখি। এ জন্য মানবস্বাস্থ্য রক্ষায়, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র যেভাবে সচেতন ও সতর্ক থাকে, ঠিক তেমনিভাবে পশুপাখির রোগপ্রতিরোধে বিশেষ নজর দিতে হবে সবাইকেই।

খেজুরের গুড় অনেকেরই পছন্দের। প্রথম আলো ফাইল ছবি

চিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, নিপাহ ভাইরাস পশুপাখি থেকে মানুষে ছড়ায়। বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাস মূলত ছড়ায় বাদুড়ের মাধ্যমে। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এ সময়টাতে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে। পাশাপাশি বাদুড় হাঁড়িতে মলমূত্র ত্যাগ করায় ও রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যাওয়ায় ভাইরাস সংক্রমণের শঙ্কা থাকে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের কোনো ওষুধ না থাকায় সংক্রমণ ঠেকাতে সচেতনতার বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, কাঁচা রস খেলে মানুষ নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। নিপাহ ভাইরাসের কোনো ওষুধ আবিষ্কার না হওয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে ৭০ থেকে ৯০ ভাগ। আর বেঁচে যাওয়া রোগীদের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ ভাগ স্নায়বিক দুর্বলতায় ভুগতে থাকেন।

নিপাহর সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সতর্ক ও সচেতনতার জন্য কাঁচা খেজুরের রস–সংক্রান্ত যেকোনো আয়োজন থেকে বিরত থাকতে হবে। খেজুরের রস, তালের কাঁচা রস না খাওয়ার পাশাপাশি বাদুড়ের খাওয়া কোনো আংশিক ফল খেলেও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে।

সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত নিপাহ ভাইরাস–বিষয়ক এক সম্মেলনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটি মারাত্মক মহামারির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত ও প্রতিরোধে নিয়োজিত ‘কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন্সের’ (সিইপিআই) প্রধান নির্বাহী রিচার্ড হ্যাচেট বলেন, নিপাহ ভাইরাস শনাক্তের পর প্রায় ২ যুগ কেটে গেছে। তবে এর বিপরীতে স্বাস্থ্যঝুঁকি সামলানোর পর্যাপ্ত উপকরণ এখনো বিশ্বে নেই। এই ভাইরাসের প্রার্দুভাব এখন পর্যন্ত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সীমাবদ্ধ হলেও এটি মারাত্মক মহামারি রূপ নিতে পারে বলেও হুঁশিয়ার করেন তিনি।

গবেষকেরা জানান, গা পুড়ে যাওয়া জ্বর, হঠাৎ শ্বাসকষ্ট, নিম্ন রক্তচাপ, মাঝারি থেকে প্রচণ্ড মাথাব্যথা, অবসাদ, সব সময় ঘুমঘুম ভাব নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সাধারণ উপসর্গ। এসব উপসর্গ থেকে আক্রান্ত ব্যক্তি এনকেফালাইটিসের শিকার হয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোমায় চলে যেতে পারেন। এলাইজা টেস্ট, পিসিআর, সেল কালচার প্রভৃতি পরীক্ষার মাধ্যমে এই ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব। আশার কথা হলো, বাংলাদেশের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইআইডিসিআরবি ইতিমধ্যে দ্রুত এই রোগ শনাক্ত করে বিশেষ সাফল্য দেখিয়েছে।

মোহাম্মদ আবু নোমান, কদমতলী, ঢাকা।
abunoman1972@gmail.com