প্রত্যেক নারীর একক সত্তা রয়েছে, নিজ নামে পরিচিত হওয়ার অধিকার রয়েছে।
বিয়ের আগে কারও মেয়ে, কারও বোন, বিয়ের পর কারও স্ত্রী, কারও মা—জীবনচক্রে এই পরিচয়গুলো নারীর নিজ সত্তাকে আড়ালে ফেলে দেয়। কোনো কোনো নারী এসব সম্পর্কের পরিচয়ের মধ্যে কাটিয়ে দিতে বাধ্য হয় পুরোটা জীবন। নারীর জন্য অস্তিত্বসংকট তৈরির এই মানসিকতা সমাজের গভীরে গেঁথে রয়েছে। তবে অনেক নারীই প্রচলিত ধ্যানধারণাকে ভেঙে ভিন্ন ভিন্ন জগতে কাজের মাধ্যমে নিজ পরিচয়ে জ্বলজ্বল করছেন। নিজ নামে পরিচিত তেমন ১০ জন নারী এক হয়েছিলেন গতকাল বুধবার রিন (ইউনিলিভার) আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে। অনুষ্ঠানের সহযোগী ছিল প্রথম আলো।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ‘নিজের নামেই উজ্জ্বল হোক নারীর পরিচয়’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত নারীরা বলছিলেন কাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পেছনের গল্পগুলো। যে গল্পগুলোর কোনোটাই সহজ নয়। টিকে থাকার তাগিদে লড়াই ও সাহসিকতার গল্প। সেই সঙ্গে তাঁরা বলেছেন, নিজ নামে পরিচিত হতে নারীর মধ্যে আকাঙ্ক্ষা তৈরিতে এবং নারীর নিজস্ব পরিচয়কে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরিতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। ওই নারীরা কেউ খেলা, সাংবাদিকতা, কেউ ব্যবসা, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যুক্ত, কেউ ভ্রমণে আনন্দ খোঁজেন, কেউবা ইউনিফর্ম গায়ে চাপিয়ে নারীকে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ তৈরি করেন। আমন্ত্রিত ১০ নারী বলেন, পরিবার থেকে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে, যা দেখে ওই পরিবারের শিশু নারীকে মর্যাদা দিতে শিখবে।
অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ১০ নারীর একজন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীতশিল্পী সোমনূর মনির কোনাল বলেন, তাঁর অর্জনে তাঁর পরিবারের সবাই ভাগীদার। এর মানে এই নয় যে তাঁর শ্রম–ঘ্রামে পাওয়া কষ্টার্জিত অর্জন অন্য কারও। অনেকেই আছেন, যাঁরা এই অর্জনের কৃতিত্ব তাঁকে না দিয়ে অন্য কারও বলে অসম্মান করতে চান। তাঁর মতে, এ দেশে নিজ নামে পরিচিত নারীকে অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের নেতিবাচক প্রবণতার মুখোমুখি হতে হয়।
ছোটবেলায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে ছেলেদের সঙ্গে যখন ক্রিকেট খেলতেন, তখন কম বিদ্রূপ শুনতে হয়নি জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক খেলোয়াড় সাথিরা জাকির জেসিকে। কেউ কেউ হাস্যরস করে ডাকত ‘জেসি ভাইয়া’। এসব গায়ে না মেখেই মা–বাবার অনুপ্রেরণা নিয়ে এগিয়েছেন তিনি। বললেন, নিজ নামে পরিচিত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে সফল হয়েছেন।
বিশেষ পুলিশ সুপার মাহফুজা লিজা বলেন, সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনি সুরক্ষাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও নারীর অবদান ও সামর্থ্যকে খাটো করে দেখার প্রবণতা রয়েছে সমাজে। এ থেকে উত্তরণের জন্য পরিবারে ছেলে ও মেয়েসন্তানকে ভিন্ন চোখে দেখার প্রবণতা দূর করতে হবে। কাজের ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, বিচারপ্রার্থী নারীরা পুলিশের ইউনিফর্মে একজন নারীকে দেখলে কথা বলার আত্মবিশ্বাস পান, বেশি নিরাপদ বোধ করেন।
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শাহ্নাজ মুন্নী ২৫ বছর আগে যখন মাঠে–ঘাটে দৌড়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন, তখন এ পেশায় মেয়ের সংখ্যা ছিল অনেক কম। কাজের মাধ্যমে নারী সাংবাদিকেরা মানুষের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। তিনি বলেন, ‘এ পেশায় আমি নিজেকে গড়ে তুলেছি। লড়াইটি ছিল একার লড়াই। নারী লড়াই করে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করতে পারলে কেউ তা মুছে দিতে পারবে না।’
অনলাইনভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সহজ ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা কাদির বলেন, সমাজে মেয়েরা যেন নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সে জন্য নারী–পুরুষ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হওয়া অপমানজনক। পাঠ্যবইয়ে নারী–পুরুষের প্রচলিত চিত্রায়ণেও পরিবর্তন আনতে হবে। একজন সন্তান যেন এটাও শেখে যে ‘বাবা বাসন ধুচ্ছেন, মা অফিসে যাচ্ছেন’।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিরা দেওয়ান বলেন, মা–বাবা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। যে স্কুলে পড়তেন, সেখানে বাবা–মায়ের পেশা ও আর্থিক সক্ষমতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। এমন এক পরিবেশে বৈষম্যের শিকার হয়ে উপলব্ধি করলেন নিজের একটি পরিচয় তৈরি করতে হবে। এখন শামিল হয়েছেন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে।
ক্ষমতায়নের লড়াইয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে মেয়েদের এগিয়ে আসার ওপর জোর দিয়ে বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বিডিওএসএনের সিইও কানিজ ফাতেমা বলেন, দেশে শিক্ষার সব পর্যায়ে ছেলেমেয়ের অংশগ্রহণ প্রায় সমান। এরপরও বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতে মেয়েদের পড়াশোনার হার ২০ শতাংশের নিচে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মেয়েদের অংশগ্রহণ ১০ শতাংশের নিচে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারী উদ্যোক্তা মাত্র ৪ শতাংশ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে পেশির কোনো মূল্য নেই, এখানে বুদ্ধিদীপ্ততাই মুখ্য। তাই প্রযুক্তি খাতে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে নারীদের এ খাতে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ—ভ্রমণকন্যার সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক সাকিয়া হক স্কুটি চালিয়ে ভ্রমণ করেছেন ৬৪ জেলা। ঢাকা মেডিকেল কলেজে শেষ বর্ষে পড়ার সময় সহপাঠী বন্ধু মানসী সাহাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ—ভ্রমণকন্যা নামের সংগঠন, যার সদস্যসংখ্যা এখন ৬৫ হাজার ছাড়িয়েছে। ভ্রমণকালে স্কুলে স্কুলে বাইক থামিয়ে নেমে পড়েন, শিশুদের শেখান প্রজননস্বাস্থ্যসহ শিক্ষামূলক বিষয়। সাকিয়া হক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশকে এমন দেখতে চান, যেখানে একজন মেয়ে একা ঘুরতে পারে, ট্রেকিং করতে পারে, ভ্রমণ করতে পারে।
লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলাম বলেন, অনেক পথ পেরিয়ে নিজের পরিচয় তৈরি করতে হয়েছে। বাধা সরিয়ে আসতে হয়েছে। অর্জন বা সফলতায় পরিবার খুশি হলেও পেশার শুরুতে লড়াইটা একার হয়। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াইয়ে নারীকে অনেক বেশি শ্রম দিতে হয়। নারীদের ক্ষেত্রবিশেষে না বলা শিখতে হবে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক। তিনি বলেন, নামের সঙ্গে মর্যাদার বিষয়টি যুক্ত। কেউ তা হারিয়ে ফেলতে চায় না। প্রত্যেক নারীর একক সত্তা রয়েছে, নিজ নামে পরিচিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। আর পরিচয়ের প্রথম জায়গাটি হলো কাজ, যা আত্মবিশ্বাস তৈরি করে।