নিচে বিস্ফোরক, ওপরে বসবাস

স্বামী মো. ফায়সালের লাশের খোঁজে সন্তান নিয়ে মর্গে এসেছেন ফাতেমা আক্তার (ডানে)। ডিএনএ নমুনা দিয়ে কাঁদছেন তিনি। মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন মেয়ে ফাবিহা তাসনীম। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে। ছবি: হাসান রাজা
স্বামী মো. ফায়সালের লাশের খোঁজে সন্তান নিয়ে মর্গে এসেছেন ফাতেমা আক্তার (ডানে)। ডিএনএ নমুনা দিয়ে কাঁদছেন তিনি। মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন মেয়ে ফাবিহা তাসনীম। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে।  ছবি: হাসান রাজা
>

• পুরান ঢাকা ঘিঞ্জি ও ঘনবসতিপূর্ণ
• এখানেই দেশের বড় রাসায়নিক ব্যবসাকেন্দ্র
• আছে বহু কারখানা ও গুদাম
• বেশির ভাগ বাড়ির নিচের গুদামে দাহ্য বস্তু

পুরান ঢাকা আবাসিক না শিল্প এলাকা—সেটা নিয়ে ধন্ধে পড়তে হয়। এমনিতেই লোক গিজগিজে ঢাকা। এর মধ্যে পুরান ঢাকা আরও বেশি ঘিঞ্জি ও ঘনবসতিপূর্ণ। আর এখানেই গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় রাসায়নিক ব্যবসাকেন্দ্র। আছে আরও বহু ধরনের কারখানা ও গুদাম। রীতিমতো বিস্ফোরকের ওপর বসবাস করছেন এখানকার বাসিন্দারা।

সরেজমিন দেখা যায়, বেশির ভাগ বাড়ির নিচে গড়ে তোলা কারখানা ও গুদামগুলোতে রয়েছে অতি দাহ্য বস্তু। আগুন লাগলে বের হওয়ারও পথ নেই। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো এসব গলিতে ঢুকতে পারে না। বুধবার রাতে পুরান ঢাকার অন্যতম প্রসাধনী ও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবসাকেন্দ্র চুড়িহাট্টায় আগুন লেগে ৬৭ জন নিহত হওয়ার অন্যতম কারণও ছিল এটি।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জীবিকার তাগিদেই তাঁদের জীবনের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানই অনিয়ম ও ঝুঁকির বিষয়গুলো জানে। তাদের সামনেই এই ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাপন চলছে বছরের পর বছর। বড় দুর্ঘটনার পরই বিষয়গুলো নিয়ে নড়াচড়া হয়। আবার কিছুদিন পর তা থেমেও যায়।

যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল শুক্রবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এ ঘটনার পর সরকার নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে না। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, তার জন্য কাজ করছে সরকার।’ তাঁর মতে, সেখানে নিবিড় নজরদারির অভাব ছিল।

পুরান ঢাকার রাসায়নিকের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁরা এই এলাকা ছাড়তে চান। কিন্তু সরকার গুদাম সরাতে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কিছু করেনি।

সরেজমিনে ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাসায়নিক ছাড়াও প্লাস্টিক, প্রসাধনী, কাগজ, লোহা, কাপড়, বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস, তৈজসপত্রসহ নানা পণ্যের গুদাম রয়েছে পুরান ঢাকায়। এ ছাড়া আছে প্লাস্টিকের গুটি তৈরি, প্রসাধনী, জুতা, আঠা, যানবাহনের যন্ত্রাংশ, রাবার ও প্লাস্টিকের বিভিন্ন উপকরণ, কার্টন ইত্যাদি তৈরির কারখানা। এসব গুদাম ও কারখানায় অতি দাহ্য বস্তুর ছড়াছড়ি। বহুতল ভবনে এসবে আগুন লাগলে সরু গলির কারণে মানুষের জন্য দ্রুত বের হওয়াও কঠিন। বেশির ভাগ রাস্তা এতটাই সরু যে সেগুলোকে গলি বলাই ভালো।

 নিমতলী ও চুড়িহাট্টার মতো গণমৃত্যুর ঘটনা ছাড়াও এসব এলাকায় প্রায়ই ছোটখাটো অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। গত বছরের ১৬ জুন লালবাগের ইসলামবাগের বাগানবাড়ি এলাকায় আগুনে পুড়ে যায় ১৬টি কারখানা ও ২০টি গুদাম। গত বছরের আগস্টে পাশের এলাকা লালবাগের আলীঘাটে আগুন লেগে বেশ কয়েকটি ঘর পুড়ে যায়। এর আগের বছর ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামবাগের একটি চারতলা বাড়ির নিচতলায় থাকা প্লাস্টিক কারখানা থেকে আগুন ছড়িয়ে তিনজন নিহত হন।

ফায়ার সার্ভিসের লালবাগ এলাকায় ওয়্যারহাউস পরিদর্শক নাসরিন সুলতানা জানান, বসতবাড়িতে প্রচুর কারখানা-গুদাম স্থাপনের কারণে এখানে নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। সরেজমিনে স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায়, এমন ঝুঁকির মধ্যে থেকেও তাঁদের তেমন দুশ্চিন্তা নেই। যদিও প্রতিবছরই অগ্নিকাণ্ড, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়াসহ নানাভাবেই হতাহত হচ্ছেন মানুষ।

বিস্ফোরণোন্মুখ পুরান ঢাকা
চকবাজারের ইমামগঞ্জ থেকে মিটফোর্ড রোডে ঢুকতেই রাসায়নিকের গন্ধ নাকে আসে। এই সড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে শত শত রাসায়নিক ও সুগন্ধির দোকান। আর বেড়িবাঁধ থেকে ঢাল বেয়ে নেমে যে রাস্তাটি লালবাগের ইসলামবাগের দিকে গেছে, তার দুই পাশের ঘরবাড়িগুলোর বেশির ভাগের পুরোটা অথবা একাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে কারখানা, গুদাম বা দোকান হিসেবে। মাথার ওপর তারের জট, সারিবদ্ধ ট্রান্সফরমার আর সরু গলি।

চকবাজারের উর্দু রোড, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, নন্দ কুমার দত্ত রোডেও প্রচুর রাসায়নিক ও প্লাস্টিকের কাঁচামালের গুদাম দেখা যায়। গত বুধবার রাতে চুড়িহাট্টায় আগুন লাগার পর এখানকার বেশ কিছু গুদাম থেকে কয়েক শ বস্তা প্লাস্টিকের গুটি (কাঁচামাল) সরিয়ে ফেলা হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।

এসব গুদাম খুঁজতে খুঁজতে গতকাল দুপুরে কসাইটুলীর কাজীমুদ্দিন রোডে গেলে সেখানকার লোকজন একটি ছয়তলা ভবন দেখিয়ে বলেন, প্রতি রাত ১০টার পর এই বাড়ির নিচে অবস্থিত গুদামে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মিশ্রণের কাজ হয়। এর উৎকট গন্ধে আশপাশের বাড়ির মানুষ অতিষ্ঠ। ওই বাড়ির মালিক বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ ফয়জুর রহমান। তিনি ওই সময় বাড়িতে থাকলেও এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।

চকবাজার, চুড়িহাট্টা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী তৈরির কারখানা বাড়িতে বাড়িতে। যার বেশির ভাগই ‘নকল’ বলে স্বীকার করছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের শ্যাম্পু, লোশন, ক্রিম তৈরি করে নামকরা কোম্পানির মোড়কে বিক্রি করেন।

কসাইটুলীর গড়ে ৮০ শতাংশ আবাসিক বাড়ির নিচতলায় পুরোনো কাগজের টুকরার গুদাম রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্থানীয় বাসিন্দা মো. রমজান বলেন, এসব গোডাউনে কয় দিন পরপরই আগুন লাগে। মহল্লার লোক আতঙ্কে থাকে।

এই এলাকার কাউন্সিলর (ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড) বিল্লাল শাহ প্রথম আলোকে বলেন, কেমিক্যাল ও পারফিউমসহ পুরান ঢাকার বাণিজ্যিক কার্যক্রম শহরের বাইরে সরিয়ে নিতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

কাগজের জন্য সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বাবুবাজার ও নয়াবাজার। বাবুবাজারের সৈয়দ হাসান আলী লেনে প্রায় প্রতিটি বাড়ির নিচে কাগজের দোকান ও গোডাউন আছে। অথচ এলাকাটিতে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার কোনো পথ নেই।

আর সিদ্দিকবাজার প্রসিদ্ধ জুতার কারখানার জন্য। ইসলামপুরে কাপড়ের গুদাম, পাটুয়াটুলীতে বইয়ের দোকান, প্যারীদাস রোডে টায়ারের দোকান ও গুদাম, নবাবপুরে ইলেকট্রনিকসের দোকান, লালবাগ, ইসলামবাগ এবং শহীদনগরে জুতা ও প্লাস্টিকের কয়েক হাজার কারখানা, দোকান ও গুদাম রয়েছে।

চুড়িহাট্টার পোড়া বাড়িটা থেকে কয়েক গজ দূরে হায়দার বখস লেনে গুদাম ও দোকান ভাড়ার বিজ্ঞাপন সাঁটিয়ে রেখেছিলেন এক বাসার মালিক। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, একতলা একটি বাড়ির ৩০০ বর্গফুটের জায়গা ভাড়া নিতে হলে ১ লাখ টাকা অগ্রিম ও মাসে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। ওই বাড়ির মালিক প্লাস্টিকের দানার গুদাম বা দোকান ভাড়া দিতে রাজি আছেন বলে জানান। এ রকম ঘটনার পরও তিনি কেন গুদামই ভাড়া দিতে চান প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছুদিন পর এটা ভেঙে ফেলব, সে জন্য গুদামই ভালো।’ ওই ব্যক্তি নিজের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

স্থানান্তর চান ব্যবসায়ীরাও
রাসায়নিক ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এখান থেকে সরতেই চান। অনেকেই এর মধ্যে গুদাম সরিয়েছেন। কিন্তু এটি দেশের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র হওয়ায় তাঁদের জন্য দোকান সরানো কঠিন। সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত কিছু হয়নি। তিনি জানান, তাঁদের সমিতির সদস্য ব্যবসায়ীর সংখ্যা আড়াই হাজারের মতো। এ ছাড়া ক্ষুদ্র পরিসরে আরও বহু মানুষ এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

ব্যবসায়ীরা বলেন, বেনজিন, ইথাইল অ্যালকোহল, মিথাইল অ্যালকোহল, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ইত্যাদিসহ অতি দাহ্য ২৯টি রাসায়নিক আমদানি ও মজুতের জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। দেখা যাচ্ছে, বড় ব্যবসায়ীরা অনুমোদন নিয়ে নিয়মমতো সেগুলো সংরক্ষণ করতে পারলেও ছোট অনেক ব্যবসায়ী তা করেন না।

মিটফোর্ড এলাকার রাসায়নিকের ব্যবসায়ী এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পাকিস্তান আমল থেকে ওই এলাকায় তাঁর বাবার রাসায়নিকের ব্যবসা। বাংলাদেশ হওয়ার পর তাঁরা চার ভাইও একই ব্যবসায় যুক্ত হন। তিনি বলেন, একেকটা দুর্ঘটনার পর পরিস্থিতি এমন হয় যে রাসায়নিকের ব্যবসায়ীদের ধরে বেঁধে কারাগারে নিয়ে যেতে পারলেই যেন সমাধান হবে। কিন্তু সমস্যাটার শিকড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন না কেউ।

এনায়েত হোসেনের মতে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ব্যবসা সরাতে প্রস্তুতি ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সরাতে সরকারকে বেগ পেতে হয়েছে, কারণ ব্যবসায়ীরা হাজারীবাগ ছাড়তে চাননি। কিন্তু রাসায়নিকের ব্যবসায়ীরা পুরান ঢাকা ছাড়তে রাজি। কিন্তু সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এটা সম্ভব নয়। কোনো ব্যবসায়ী সেখানে এককভাবে দোকান সরিয়ে নেওয়ার ঝুঁকি নেবেন না।