‘দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, যারা প্রতিবাদ করতে পারে না, তাদের সহ্য করে যেতে হয়। তারা কোথায় বিচার চাইবে। বিচার চাইলে আগে টাকা দিতে হবে। যাদের টাকা নেই, তাদের সহ্য করতে হবে।’
গৃহকর্মী সালেহা (১৮-ছদ্মনাম) বলেছেন কথাগুলো। রাজধানীর একটি বাসায় সহকারী হিসেবে কাজ করেন তিনি। সালেহার মতো এমন অবস্থা অনেক গৃহকর্মীর। রাজধানীর বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করা নারী কর্মীদের ৩০ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হন। কিন্তু তাঁরা এসব কথা কাউকে বলতেও পারেন না। বিচারও পান না।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে এই চিত্র উঠে এসেছে। ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ও সবুজের অভিযান ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় এই গবেষণা করে বিআইজিডি। গত বছরের (২০২১) জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গবেষণার কাজ হয়। আগামীকাল বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে এই গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হবে।
বিআইজিডির জরিপ পরিচালিত হয় গৃহকর্মী নারী এবং বিভিন্ন কৃষি প্রক্রিয়াজাত কারখানায় কাজ করা নারী কর্মীদের ওপর। বিআইজিডির জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, দেখা গেছে, গৃহকর্মীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং কারখানার নারী কর্মীদের ২০ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হন। দেশের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক—দুই খাতেই যৌন নির্যাতন ঘটে ব্যাপক হারে। তবে এর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতে হয়রানির পরিমাণ অনেক বেশি।
বিআইজিডির জরিপে অংশ নেন ২৫০ জন নারী কর্মী। তাঁরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়ি এবং ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন কারখানায় কাজ করেন। গুণগত পদ্ধতিতে এ গবেষণা হয়। এখানে জরিপের পাশাপাশি এসব নারী কর্মীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
জরিপে অংশ নেওয়া ৮০ শতাংশ গৃহকর্মী জানান, তাঁরা অন্য কর্মীদের নির্যাতনের কথা শুনেছেন বা দেখেছেন—এমন অভিজ্ঞতা আছে ৪০ শতাংশ কারখানা কর্মীর।
গৃহকর্মী ও কারখানার শ্রমিক নারী—উভয়ই নানা ধরনের যৌন হয়রানির কথা বলেছেন। এর মধ্যে আছে যৌন ইঙ্গিত দিয়ে করা কটাক্ষ, উক্তি, মন্তব্য এবং সরাসরি যৌন অবমাননা। তাকিয়ে থাকা, কটাক্ষ করা বা খারাপ অঙ্গভঙ্গি করার ঘটনা গৃহকর্মীদের সঙ্গেই বেশি হয়। বেশির ভাগ গৃহকর্মী অন্তত একবার শারীরিক অবমাননার শিকার হয়েছেন বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কিছু গৃহকর্মী গুরুতর শারীরিক অবমাননার মধ্য দিয়ে গেছেন বলেও জানিয়েছেন।
কর্মক্ষেত্রে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব ও যৌন হয়রানি বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রশংসা, সাহায্য করা বা সহানুভূতির স্থলেও হয় বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গৃহকর্মীরা সাধারণত তাঁদের নিয়োগকারী পরিবারের পুরুষ সদস্যের মাধ্যমে এসব হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। আর কারখানায় কাজ করা নারীদের ক্ষেত্রে তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব না করলেও সহকর্মীদের মাধ্যমে এ ধরনের হয়রানির শিকার হন। এ ছাড়া রাস্তা বা কারখানার বাইরেও কর্মীরা হয়রানির শিকার হন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাসাবাড়িতে কাজ করা নারী কর্মীরা একা একা কাজ করার কারণে আরও বেশি অসহায় বোধ করেন। অন্যদিকে কারখানায় কাজ করা নারীরা তাঁদের সহকর্মীদের সঙ্গে থাকেন। একাধিক কারখানায় নারী ও পুরুষদের আলাদা কাজ করার সুযোগ থাকে। যে কারণে গৃহকর্মীদের তুলনায় তাঁরা সুরক্ষিত বোধ করেন।
গৃহকর্মীদের মধ্যে তিনটি শ্রেণি আছে। একটি হলো যাঁরা স্থায়ীভাবে বাসাবাড়িতে থাকেন। দ্বিতীয়, যাঁরা বাসাবাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকেন না, যাওয়া-আসা করেন। তাঁদের ‘ঠিকা গৃহকর্মী’ হিসেবেও বলা হয়। আর তৃতীয় হলো গৃহকর্মী সরবরাহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োজিত কর্মীরা।
বেসরকারি সংগঠন কর্মজীবী নারীর পরিচালক (কর্মসূচি) সানজিদা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, এই তিন শ্রেণির মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থা তাঁদের, যাঁরা বাসাবাড়িতে থাকেন। তাঁদের অভাব-অভিযোগের কথা তাঁরা বলতে পারেন না। তাঁদের বিচার চাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। ঠিকা যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাজ ছেড়ে দেওয়ার স্বাধীনতা আছে। আর অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় থাকেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাঁরা আসেন, তাঁরা।
সানজিদা সুলতানা বলেন, ‘গবেষণায় যে চিত্র উঠে এসেছে, তা বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলেই মনে হয়।’
গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহকর্মী এবং কারখানার কর্মী নারী—উভয়ই সম্মান ও লজ্জার কারণে তাঁদের ওপর নিগ্রহের কথা কাউকে বলতে দ্বিধা করেন। এ ধরনের ঘটনা সম্পর্কে কী বলা হবে, কাকে বলা হবে এবং কীভাবে বলা হবে, তা নিয়ে কর্মীরা চিন্তায় থাকেন। যখন কর্মীরা প্রশাসন বা মালিকের সঙ্গে কথা বলেন, তখন ভাষা বদলে ফেলেন।
গৃহকর্মীদের জন্য আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করার ব্যবস্থা নেই। কারখানায় কর্তৃপক্ষ বা মানবসম্পদ বিভাগ আছে। তবে কারখানায় এই ব্যবস্থা থাকলেও বেশির ভাগই তাঁদের অভিযোগ জানান না বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিচালক কোহিনূর মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, নারী গৃহকর্মীদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। তাঁদের কোনো মজুরি কাঠামো নেই, কর্মঘণ্টা নেই, তাঁদের কোনো ট্রেড ইউনিয়ন নেই। তাঁদের এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সংগঠিত করার কোনো বিকল্প নেই।