এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ১ কোটি মানুষ।
মাফি ইসলাম (৩৫) ২০১১ সালে ছোট বোনের সন্তান প্রসবের সময় রক্ত দিতে হাসপাতালে যান। তখন পরীক্ষায় তাঁর শরীরে ধরা পড়ে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। এরপর থেকে ৬ মাস পরপর তিনি চিকিৎসকের কাছে যান। কিছু ওষুধ খেয়ে তিনি এখন সুস্থই আছেন। মাফি বলেন, তাঁর মা-ও ওই ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন।
মাফি ইসলামের মতো দেশের তরুণ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হেপাটাইটিস বি ও সিতে। চিকিৎসকেরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে চলাচল বেশি করায় কর্মক্ষম ও যুবক তরুণদের মধ্যে সংক্রমণের হার বেশি।
আজ ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। ‘হেপাটাইটিস নিয়ে অপেক্ষা নয়’ প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
হেপাটাইটিস নিয়ে কাজ করা দেশের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হেপাটোলজি সোসাইটির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রায় ১ কোটি। তাঁদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে সংক্রমিত প্রায় ৮৫ লাখ। এর মধ্যে ৬ দশমিক ৩ শতাংশই ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী। এ ছাড়া ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আক্রান্তের হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ২ হাজার ৭১৩ জনের ওপর গবেষণা করে এই তথ্য পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
গবেষণায় দেখা গেছে, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৫৭ লাখ পুরুষ ও ২৮ লাখ নারী। শহরে আক্রান্তের হার বেশি।
হেপাটোলজি সোসাইটি জানিয়েছে, হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৬০ শতাংশের বয়স ৩০ থেকে ৪৫ বছর। নানা অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যাওয়া ৩০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেশি।
* হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে সংক্রমিত প্রায় ৮৫ লাখ। * এর মধ্যে পুরুষ ৫৭ লাখ, নারী ২৮ লাখ। * শহরে আক্রান্তের হার বেশি।
তরুণদের বি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে হেপাটোলজি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শাহিনুল আলম বলেন, ‘আমাদের দেশে ২০০৫ সালের দিকে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকাদান শুরু হয়। এর আগে যাঁদের জন্ম, তাঁদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি। যার ফলে এখনকার তরুণ এবং যুবকদের মধ্যে বি ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি।’
তবে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলেই তা মারাত্মক—এমনটা নয় বলে জানান হেপাটোলজির চিকিৎসক শাহিনুল আলম। তিনি বলেন, বেশির ভাগ এটার বাহক। এদের শুধু ফলোআপ চিকিৎসায় রাখলেই হয়। আর যাঁরা ক্রনিক হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত, তাঁদের চিকিৎসা না দিলে লিভার ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর হেপাটাইটিস সি হলে চিকিৎসা নিতেই হবে।
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ছড়ানোর কারণ হিসেবে শাহিনুল আলম বলেন, যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার হয়, তা বারবার ব্যবহার এবং সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করতে না পারার ফলে সংক্রমণ ছড়ায়। তিনি জানান, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হবে।
তবে দেশে আগের চেয়ে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ কমেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিএসএমএমইউর ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব বলেন, টিকাদানের কারণে দেশে ৫ বছর বয়সীদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। যেটা বড়দের মধ্যে সাড়ে ৫ শতাংশ।
সফল টিকাদান কর্মসূচির কারণে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সংক্রমণ কমার কথা বলেছেন শাহিনুল আলমও। তিনি বলেন, শিশুদের প্রায় ৯৫ শতাংশই টিকার আওতায় আছে। এ ভাইরাস বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুকালে মায়ের কাছ থেকে আসে।
সংক্রমণ শহরে বেশি হওয়ার বিষয়ে ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, শহর ঘনবসতি এবং ভাইরাস ছড়ানোর উৎসগুলোও এখানে বেশি। রক্ত দেওয়া, চিকিৎসার কারণে হাসপাতালমুখী বেশি হওয়া, ইনজেকশন নেওয়া ও মাদকাসক্তের পরিমাণও বেশি। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে চলাচল বেশি করায় কর্মক্ষম ও যুবক-তরুণদের মধ্যে সংক্রমণের হার বেশি।
বাংলাদেশে হেপাটাইটিস পরিস্থিতির বিষয়ে মোহাম্মদ আলী বলেন, বাংলাদেশের হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিদের প্রতি ১০ জনের ৯ জন তাঁদের শরীরে ভাইরাস দুটির অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন নযন। তাঁরা অজান্তেই অন্যকে সংক্রমিত করেন। হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস নীরবে যকৃৎকে (লিভার) ধ্বংস করে দেয়। যার ফলে লিভার সিরোসিস, লিভারের ক্যানসার ও শেষ পর্যন্ত লিভারকে অকার্যকর করে দেয়। বিশ্বে ভাইরাল হেপাটাইটিস হচ্ছে মৃত্যুর দশম এবং লিভার ক্যানসার তৃতীয় কারণ।
হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসের কারণে দেশের কত মানুষ মারা যায়, তার সর্বশেষ পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২১ হাজার মানুষ যকৃতের অসুখের কারণে মারা যায়।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে হেপাটাইটিসের চিকিৎসা কিছুটা ব্যাহত হয়েছে বলে জানান শাহিনুল আলম। তিনি বলেন, করোনার মধ্যে অন্যান্য টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হয়েছে। এ ছাড়া শনাক্তকরণও কমেছে।