আয়েশা সিদ্দিকা

নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না, এমন কথা আইনে নেই

আয়েশা সিদ্দিকা
আয়েশা সিদ্দিকা

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জন্য নিকাহ রেজিস্ট্রার পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল সরকার। তাতে প্রার্থী হয়েছিলেন আয়েশা সিদ্দিকা। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে তিনি চাকরিতে যোগ দিতে ব্যর্থ হন। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চও আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। সম্প্রতি হাইকোর্টের ওই রায় প্রকাশিত হয়েছে। নারীরা কেন নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না, তা নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে চলছে নানা আলোচনা। এসব বিষয় নিয়েই কথা হচ্ছিল আয়েশা সিদ্দিকার সঙ্গে। ন্যায়বিচারের জন্য যত দূর যেতে হয়, তত দূরই যাবেন তিনি। প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সে কথাই জানালেন।

প্রশ্ন

হাইকোর্টের রায় প্রকাশ হওয়ার পর নিকাহ রেজিস্ট্রার পদে নারীদের নিয়োগ প্রসঙ্গে আলোচনা চলছে বিস্তর। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

আয়েশা সিদ্দিকা: আমি এই প্রসঙ্গে কে কী লিখছেন, কে কী বলছেন, সবই দেখছি। অনেকে সরাসরি আমার সঙ্গেও কথা বলছেন। আমি যত দূর সম্ভব কথা বলছি। বেশির ভাগ মানুষকেই নিকাহ রেজিস্ট্রার পদে নারীদের নিয়োগ নিয়ে ইতিবাচক কথাই বলতে দেখছি। বুঝতে পারছি আমি আসলে একা না। আমার সঙ্গে আরও অনেকে আছেন।

প্রশ্ন

নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাজটা পছন্দ করলেন কেন?

আয়েশা সিদ্দিকা: এই প্রশ্নের উত্তরটা একটু বড় হবে। ২০১২ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার অফিস নিকাহ রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাপে। আমার মামাতো ভাই কাজী সাইফুর রহমানের চোখে পড়েছিল লেখাটা। উনি পেশায় নিকাহ রেজিস্ট্রার। বললেন, নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে যে যে যোগ্যতা প্রয়োজন, সবই আমার আছে। কেন আমি প্রার্থী হচ্ছি না। কথাটা আমার মনে ধরল। ভাবলাম বাংলাদেশে নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার নেই। কাউকে না কাউকে তো শুরু করতে হবে। সেই ব্যক্তিটি আমি হলে বেশ হয়। আমার স্বামী মো. সোলায়মান হোসেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। তাঁর সঙ্গে আলাপ করলাম। তিনিও উৎসাহ দিলেন। আমার নিজের তো উৎসাহ ছিলই, পরিবারকে পাশে পেয়ে আমি জোরেশোরে প্রস্তুতি নিলাম।

প্রশ্ন

প্রার্থীকে পুরুষ হতে হবে, এমন কোনো কথা কি ছিল সেই বিজ্ঞপ্তিতে?

আয়েশা সিদ্দিকা: নাহ্‌। তাহলে তো আমি প্রার্থীই হতাম না। আসলে মুসলিমদের বিয়েটা হয় মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রিকরণ) আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী। ওই আইনেই বলা আছে, সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী প্রয়োজনীয়সংখ্যক ‘ব্যক্তি’কে নিকাহ নিবন্ধনের অনুমতি দেবেন। সেখানেও নারীরা নিকাহ নিবন্ধন করতে পারবেন না বা শুধু পুরুষই পারবেন, এমন কিছুর উল্লেখ নেই। আসলে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় কেন এই প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন, আদালতই–বা কেন এই সিদ্ধান্ত বহাল রাখলেন, আমি তার কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।

প্রশ্ন

নিয়োগের ঠিক কোন পর্যায়ে গিয়ে আপনাকে থামতে হলো?

আয়েশা সিদ্দিকা: ফুলবাড়ী উপজেলার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জন্য বরাদ্দ একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার। এই একটি পদে আমরা তিনজন প্রার্থী ছিলাম। আর তিনজনই ছিলাম নারী। আমি ফাজিল পাস করেছি। অন্য দুজন আমার নিচের ক্লাসে পড়ত। আমাদের নিয়োগ পরীক্ষা নেন পাঁচজন, সবাই পুরুষ। নিয়োগ বোর্ডের প্রধান ছিলেন সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। তিনিও চাইছিলেন একজন নারী নিয়োগ পাক এবং তাঁর এলাকা থেকেই। প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হই। কাজে যোগ দেওয়ার জন্য আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর একজন কর্মকর্তা বললেন, যেহেতু কোনো নারী নিকাহ নিবন্ধক নেই, এটা নিয়ে কথা বলতে হবে।

প্রশ্ন

এটা কোন সালের কথা?

আয়েশা সিদ্দিকা: ২০১৪ সালের। তত দিনে কিন্তু দুই বছর পেরিয়ে গেছে।

প্রশ্ন

মন্ত্রণালয় কী করল? কী বলল তারা?

আয়েশা সিদ্দিকা: ওরা পুরো প্যানেলটাই বাতিল করে দিল। মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মো. হেমায়েত উদ্দিনের সই করা একটা কাগজ পেলাম আমি। চিঠিটা ইস্যু করা হয় ২০১৪ সালের ১৬ জুন। তাতে লেখা, মুসলিম বিবাহ অনুষ্ঠান একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। নিকাহ রেজিস্ট্রির আগে তিনি বর–কনের প্রস্তাব আদান–প্রদান ও গ্রহণের বিষয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন কর থাকেন। দিন–রাত যেকোনো সময় বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হয়। তাই নারীদের দিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করানো বাস্তবসম্মত না। এরপরই আমি কোর্টে যাই।

প্রশ্ন

আদালতে আপনি যে রিট করলেন, সেখানে কী কী যুক্তি দেখিয়েছেন?

আয়েশা সিদ্দিকা: আমার আইনজীবী মো হুমায়ূন কবির। আমি ঠিক যা বলতে চেয়েছি, তিনিও তা–ই বলেছেন। যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যেকের সরকারি চাকরি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আইন বা বিধিতে যে যে শর্ত পূরণের কথা বলা হয়েছে, সেসব শর্তই আমি পূরণ করেছি। কেবল তিনজন নারী প্রার্থী হওয়ায় প্রার্থীদের প্যানেল বাতিল করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

প্রশ্ন

আচ্ছা ধরুন, আপনি নিকাহ নিবন্ধক হলেন, অনেকে তো কাজি অফিসে এসে বিয়ে করেন। সে ক্ষেত্রে বিয়ে কে পড়াবে?

আয়েশা সিদ্দিকা: আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের বেশি বয়সী যেকোনো মুসলিম ব্যক্তি বিয়ে পড়াতে পারেন। কাজেই এখানেও কোনো সমস্যা দেখছি না।
প্রথম আলো: কিন্তু আদালত তো নারীদের ‘শারীরিক সীমাবদ্ধতা’র কথাও বলেছেন, যে সময়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নারীরা অংশ নিতে পারেন না।
আয়েশা সিদ্দিকা: আপনি নিকাহ নিবন্ধনের বালাম বই দেখেছেন? ওখানে বিয়ে কে পড়িয়েছেন তাঁর স্বাক্ষরের জন্য একটি কলাম আছে, আর নিকাহ রেজিস্ট্রারের জন্য আরেকটি কলাম। নিকাহ রেজিস্ট্রার তো বিয়ে পড়ান না, তিনি শুধু নিবন্ধন করেন। এখানে ধর্মীয় কাজে অংশ নেওয়ার প্রশ্ন উঠছে কেন? নারীরা তো সব করছেন। দেশ চালাচ্ছেন, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশে আছেন। সব কাজ নারী করতে পারলে নিবন্ধনের কাজটা কেন পারবেন না? আমার বিশ্বাস, আমি আদালত থেকেই ন্যায়বিচার পাব।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: তাহলে আপনি হাল ছাড়ছেন না?

আয়েশা সিদ্দিকা: না। আমি আমার লড়াই চালিয়ে যাব। অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। এই সমর্থন বৃথা যাবে না। আর পরিবারের জোরালো সমর্থন তো আছেই। আমার স্বামী শুরু থেকে আমার সঙ্গে লড়াইয়ে আছেন। আছে আমার তিন কন্যাও।