আদালতে বিচারকাজে এগিয়ে আসছেন নারীরা। অধস্তন আদালতের বিচারকদের মধ্যে বর্তমানে প্রায় এক-চতুর্থাংশই নারী। উচ্চ আদালতেও নারীরা এগিয়ে আসছেন। তবে অধস্তন আদালতের তুলনায় কম।
যদিও ২০০০ সালের আগে উচ্চ আদালতে দেশে কোনো নারী বিচারপতিই ছিলেন না। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে ৯৫ জন বিচারপতি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে নারী বিচারপতি ৭ জন।
সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ আটজন বিচারপতি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন নারী। আর হাইকোর্ট বিভাগের মোট বিচারপতি ৮৭ জনের মধ্যে নারী বিচারপতি আছেন ছয়জন। এদিকে অধস্তন আদালতে মোট বিচারক ১ হাজার ৫১৯ জনের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৩৭৬ জন।
দেশের ইতিহাসে আপিল বিভাগে প্রথম নারী বিচারপতির নাম নাজমুন আরা সুলতানা। হাইকোর্ট বিভাগেও প্রথম নারী বিচারপতি হওয়ার কৃতিত্ব তাঁরই। ২০০০ সালে নারীদের মধ্যে দেশে প্রথমবারের মতো হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি পদে উন্নীত হন তিনি। এরপর ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারপতি হয়ে বর্তমানেও বিচারকাজ পরিচালনা করছেন।
নাজমুন আরা সুলতানা ১৯৭২ সালে জেলা কোর্টে আইনজীবী হিসেবে প্রথম নাম লেখান। ১৯৭৫ সালে মুনসেফ হিসেবে বিচার বিভাগে যোগ দেন এবং ১৯৯০ সালে জেলা ও সেশন জজ পদে উন্নীত হন।
সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্ট বিভাগে অন্য নারী বিচারপতিরা হলেন বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি জিনাত আরা, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ এবং বিচারপতি কাশেফা হোসেন।
সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি হওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোনো নারী বিচারপতি অবসরে যাননি। তবে অনেক নারী বিচারক জেলা জজ হয়ে অবসরে গেছেন।
জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ কাজী শাহিনা নিগার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারক হিসাবে নারীরা যে হারে আসছেন, আমি বলব এটা দেশের বড় ধরনের অগ্রগতিরই প্রতিফলন। তবে সংগ্রাম করেই যেহেতু নারীকে এগোতে হয়, অস্বীকার করার উপায় নেই যে সেই সংগ্রামটা এখনো আছে।’
সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাওয়া তথ্যমতে, নাজমুন আরা সুলতানার পর নারীদের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি হয়ে আসেন সালমা মাসুদ চৌধুরী। তিনি হাইকোর্ট বিভাগে ২০০২ সালে অতিরিক্ত বিচারপতি ও ২০০৪ সালে বিচারপতি পদে উন্নীত হন। তাঁর পিতা চৌধুরী এ টি এম মাসুদও বিচারপতি ছিলেন। জেলা আদালতের আইনজীবী হিসেবে ১৯৮১ সালে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন সালমা মাসুদ চৌধুরী।
বিচারপতি জিনাত আরা মুনসেফ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৭৮ সালে। ২০০৩ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি ও ২০০৫ সালে বিচারপতি হন।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব জেলা আদালতের আইনজীবী হিসেবে নাম লেখান ১৯৯২ সালে। তিনি হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হন ২০০৪ সালে ও একই বিভাগে বিচারপতি হন ২০০৬ সালে।
বিচারপতি নাইমা হায়দার জেলা কোর্টে আইনজীবী হিসেবে নাম লেখান ১৯৮৯ সালে। তিনি ২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি ও একই বিভাগে ২০১১ সালে বিচারপতি হন। তাঁর বাবা বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীও বিচারপতি ছিলেন।
বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বিচার বিভাগে মুনসেফ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৮১ সালে। ২০১০ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি ও ২০১২ সালে বিচারপতি পদে উন্নীত হন।
বিচারপতি কাশেফা হোসেন ১৯৯৫ সালে জজকোর্টের আইনজীবী হিসেবে নাম লেখান এবং ২০১৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তাঁর বাবা বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনও বিচারপতি ছিলেন।
অধস্তন আদালতে নারী বিচারক বাড়ছে
সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাওয়া বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সর্বশেষ জ্যেষ্ঠতার তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, অধস্তন আদালতে বর্তমানে ১ হাজার ৫১৯ জন বিচারক রয়েছেন। এর মধ্যে নারী বিচারক রয়েছেন ৩৭৬ জন, যা অধস্তন আদালতের মোট বিচারকের ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বছরওয়ারি হিসাব করলে দেখা যায়, বিচার বিভাগে নারীরা ক্রমাগত এগিয়ে আসছেন। এ বছরের ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) পরীক্ষায় সহকারী জজ হিসেবে ৭৯ জনের নিয়োগ পাওয়ার প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, মোট ৭৯ জনের মধ্যে ৩৭ জন নারী, যা মোট নিয়োগের ৪৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এমনকি মেধা তালিকার প্রথম ১০ জনের মধ্যে ৬ জনই নারী।
আগেরবার ২০১৪ সালে নিয়োগ পাওয়া বিচারকদের মধ্যেও নারীর অংশ ভালো ছিল। ওই বার নিয়োগ পান ৭৮ জন বিচারক, যার মধ্যে নারী ছিলেন ৩৫ জন বা ৪৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
এ ছাড়া ২০১৩ সালে ১২১ জনের মধ্যে ৩৬ জন অর্থাৎ ২৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২০১২ সালে ১১০ জনের মধ্যে ৩৩ জন অর্থাৎ ৩০ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ২০৫ জনের মধ্যে ৪৮ জন অর্থাৎ ২৩ দশমিক ৪১ শতাংশ নারী বিচারক নিয়োগ পেয়েছেন।
যোগাযোগ করলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেখছি যে নারীরা বিচার বিভাগে আশাব্যঞ্জকভাবে নিয়োগ পাচ্ছেন। আগামী দিনে বিচার বিভাগে তাঁরা আরও এগিয়ে আসতে পারবেন বলে আস্থা আছে।’