নারীরাও পিছিয়ে নেই

ভোরের সূর্য ফোটার আগেই যাঁরা পাঠকের হাতে হাতে প্রথম আলো পৌঁছে দেন, তাঁরা ভোরের যোদ্ধা। এই কঠিন যুদ্ধে নারীরাও পিছিয়ে নেই।

শেফালী পাল
শেফালী পাল

বয়স ৭৬, তবু ছুটছেন শেফালী পাল

শেফালী পাল। বয়স ৭৭ বছর ছুঁই ছুঁই। জরাজীর্ণ হাড্ডিসার শরীর নিয়ে প্রতিদিন পাঠকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেন তিনি। কক্সবাজার জেলার একমাত্র নারী হকার তিনি। সবাই তাঁকে মাসিমা বলে ডাকেন। বাড়ি ঈদগাঁও উপজেলা সদরের পালপাড়ায়।

কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়নের রুদ্রপাড়ার রবীন্দ্র রুদ্রের সঙ্গে ১৫ বছর বয়সে শেফালীর বিয়ে হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। তখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্রী। বিয়ের পর লেখাপড়া আর হয়নি। স্বামী কর্ণফুলী পেপার মিলস (কেপিএম) উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তিনি মারা যান ১৯৬৯ সালে। এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান। ছেলে স্বপন পাল ঈদগাঁও স্টেশনে পত্রিকা সরবরাহ করে সংসার চালাতেন। ২০০৮ সালের ২৫ অক্টোবর স্বপন পালের অকালমৃত্যু হলে জীবিকার তাগিদে মাঠে নামেন মা শেফালী পাল। পত্রিকা নিয়ে অফিস–আদালত, দোকানপাট ও মানুষের বাড়ি বাড়ি যান। ঝড়, বৃষ্টি, শীত বা প্রখর রোদেতাঁর বিশ্রাম নেই।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ শেফালী বর্তমানে নানারোগে আক্রান্ত। তবু থেমে নেই পথচলা।কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর শেফালীকে একটি ইজিবাইক উপহার দেন। শেফালীর নাতি জয় পাল ইজিবাইক চালিয়ে যে টাকা আয় করেন, তা দিয়েই চলছে টানাপোড়েনের সংসার।

পত্রিকা বিলি করতে করতে অনেকটা ক্লান্ত শেফালী পাল বলেন, স্বামীসূত্রে পাওয়া তাঁর সম্পত্তি নিকটাত্মীয়রা কুক্ষিগত করে রেখেছেন। সেগুলো ফিরে পেতে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চান তিনি।

শেফালী পাল হেঁটে হেঁটেই পত্রিকা বিক্রি করেন। হাতে সব সময় একটি ছাতা থাকে। শেফালী পালের মতে, সংবাদপত্র বিক্রি করার পেশাটি সম্মানের। বিভিন্ন পেশা শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে সম্মান পাওয়া যায়। এ পেশা নিয়ে তাঁর গর্বেরও শেষ নেই। তিনি চান, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকতে। সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আক্ষেপটা ভুলতেপারছেন না তিনি।

ঝুমুর দাস

ঝুমুর দাসের সংগ্রামী জীবন

পত্রিকা ব্যবসায়ী স্বামীর অনুপস্থিতিতে ব্যবসার হাল ধরেছেন ঝুমুর দাস। তাঁর বাড়ি রাজবাড়ী শহরের কলেজপাড়ার রেল কলোনি এলাকায়। তাঁর বাবার বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার আশাপুর গ্রামে। এসএসসি পাসের পর ২০০২ সালের ৫ জুন বিয়ে হয় তাঁর। ২০০৪ সালের ২৩ নভেম্বর সংসারে আসে নতুন মুখ। ছেলের নাম রাখা হয় অরণ্য দাস। অন্যসব সাধারণ স্ত্রীর মতো ঘরের কাজকর্ম করতেন। স্বামীর আয় দিয়ে সংসার চলে যেত। এরপর সংসারে ঘটে অঘটন। স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। শারীরিক অবস্থা ক্রমে অবনতির দিকে যেতে থাকে। একটানা বিছানায় পড়ে থাকেন প্রায় দেড় বছর। ২০১৮ সালের ২৫ জুন তিনি মারা যান।

ঝুমুর দাস বলেন, ‘চিকিত্সার জন্য অসুস্থ স্বামীর সঙ্গে ঢাকাতেই থাকতাম। তখন আমার ছেলে পত্রিকার ব্যবসা দেখাশোনা করত। সহকর্মীরা তাকে সহায়তা করতেন। কিছু সমস্যা হলেও মোটামুটিভাবে ব্যবসা চলছিল। কিন্তু তিন-চার মাস পরে খেয়াল করলাম, ছেলে ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারছে না। তখন আমি বাড়িতে চলে আসি। ছেলেকে সহায়তা করি। ছেলের মাধ৵মে আমাদের নির্দিষ্ট ক্রেতাদের চিনতে পারি। সমস্যায় পড়লে ফোন করে স্বামীর কাছ থেকে সহায়তা নিতাম।’

ঝুমুর দাস বলেন, ‘আমার স্বামী যখন জীবিত ছিলেন, তখন অনেক পত্রিকার এজেন্ট ছিলেন। তাঁর অসুস্থতার সময় আমরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ি। অনেক খরচ হয়েছে। অনেক পত্রিকা তাদের এজেন্সি বাতিল করেছে। তবে প্রথম আলো মানবিক কারণে সেটা করেনি। প্রথম আলোকে ধন্যবাদ।’

ঝুমুর দাস আক্ষেপ করে বলেন, ‘অনেক পত্রিকা আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন ছেপেছে। সারা দেশ আমাকে চিনেছে। অনেকে বাহবা দেয়। কিন্তু আমার থাকার জন্য নিজস্ব কোনো জমি নেই। রেলের জমিতে ঘর তুলে থাকি। যেকোনো সময় ছেড়ে দেওয়া লাগতে পারে। ঘর তোলার জন্য একটু জমি পেলে খুব ভালো হতো।’

জেসমিন আকতার

‘আমি প্রথম আলো পত্রিকার এজেন্ট’

নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলা লবগঙ্গা, মধুমতি ও ভৈরব নদী বেষ্টিত একটি দ্বীপ। যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই ভালো না। বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙনের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও অবনতি হয়। কালিয়াতে সংবাদপত্রের আলো পৌঁছাত না। বলা যায় কালিয়াবাসী ছিল অন্ধকারে। এ অবস্থায় জেসমিন আকতার এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন,‘ আমি প্রথম আলো পত্রিকার এজেন্ট হই। এখন কালিয়ায় প্রথম আলো পত্রিকা সবচেয়ে বেশি এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে পৌঁছে যায়।’

জেসমিন আকতার পত্রিকার এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কালিয়া অভিবাসী নারী কর্মী নেটওয়ার্ক সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিরাপদ শ্রম অভিবাসনের তথ্য প্রচার ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে নারীদের সহায়তা করছেন।

দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি কথা বলতে পারেন না। বাক–প্রতিবন্ধী মানুষটি খুব সকালে আড়মোড়া ভেঙে চলে আসেন পত্রিকার পরিবেশক কার্যালয়ে। পরিবেশকের কাছ থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে পত্রিকা বুঝে নিয়ে ছুটে চলেন গ্রাহকদের কাছে।

লিটন আহমদ ১২-১৩ বছর ধরে পাঠকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন প্রথম আলো পত্রিকা। সিলেট নগরের বন্দরবাজার থেকে প্রতিদিন পত্রিকা সংগ্রহ করে হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর মাজার, আম্বরখানা মোড়সহ ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে তিনি পত্রিকা বিক্রি করেন। পত্রিকা বিক্রির আয় দিয়েই চলে তাঁর সংসার। তিন মেয়ে ও স্ত্রীসহ পাঁচজনের সংসার তাঁর।

নগরের বন্দরবাজারের প্রথম আলোর পরিবেশক আলমগীর এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন ও সিলেট মহানগর হকার সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম বলেন, বাক্–প্রতিবন্ধী হলেও লিটন আহমদ অত্যন্ত পরিশ্রমী। প্রতিবন্ধী হলেও পরিশ্রম করেই সংসার চালান তিনি।

মরিয়ম বেগম

মন্দ কথায় কান দেন না মরিয়ম

দিনাজপুর কোর্ট চত্বরে নিয়মিত হাঁক দেন মরিয়ম, ‘এই প্রথম আলো, এই প্রথম আলো, আজকের তাজা খবর। একটি প্রথম আলো নেন, আজকের তাজা খবর দেখেন।’

শহরে মানুষের আনাগোনা শুরু হলে, হক পত্রিকা এজেন্সি থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করে বুকের সঙ্গে দুই হাতে পাঁজা করে হাঁটতে থাকেন। শহরের রেলস্টেশন, লিলির মোড়, মডার্ন মোড় ও নিমতলায় হাঁটতে থাকেন আর পত্রিকা বিক্রি করেন। এরপর মুন্সিপাড়া হয়ে দিনাজপুর কোর্ট চত্বর ঘুরে ঘুরে পত্রিকা বিক্রি করেন। মরিয়মকে নিয়ে প্রথম আলোর নারীমঞ্চের পাতায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল।

মরিয়ম বলেন, ‘যখন পত্রিকা বিক্রি শুরু করি, তখন অনেকেই আমাকে দেখে নানা কথা বলেছেন। তাতে কর্ণপাত না করে আমি আমার কাজ চালিয়ে গেছি।’

আড়াই বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। পড়ালেখারও সুযোগ হয়নি। ছেলেমেয়েসহ চারজনের সংসার। মরিয়মের ভাষায়, মরার আগ পর্যন্ত পত্রিকা বিক্রি করতে চান।

মরিয়ম পত্রিকা বিক্রি শুরু করার আগে বোতল, ভাঙারি, লোহাসহ বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন। ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়, স্বামী রিকশাচালক। তবে বিয়ের পরও মরিয়মকে রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। বাড়ির পাশে তরমুজ-কলা আনারসের দোকান করেছেন। সবজি বিক্রি করেছেন কখনো। এরপর একদিন স্থানীয় এক সাংবাদিকের হাত ধরে পত্রিকা বিক্রির পেশায় নামেন। মরিয়ম জানালেন, শুরুতে এজেন্ট থেকে পত্রিকা বাকি দিতে চাইত না। এখন সবাই বিশ্বাস করে।

মরিয়ম জানালেন, করোনাভাইরাস বিস্তারের পর কোর্ট-কাছারিসহ অফিসগুলোতেও ঢোকা নিষেধ ছিল। তখন কয়েকটি বাসায় পত্রিকা দিতেন, করোনার ভয়ে অনেকেই পত্রিকা নেওয়া বন্ধ রেখেছিলেন। তবে পত্রিকার মাধ্যমে করোনা ছড়ায়, এমন কথায় তীব্র প্রতিবাদ করে মরিয়ম বললেন, তাঁর তো করোনা হয়নি, তিনি তো বলতে গেলে এই পত্রিকার সঙ্গেই সারা দিন বসবাস করছেন।

তোছলিমা রহমান

ব্যবসা ও সংসারের হাল ধরেছেন

স্বামী আতিকুর রহমানের (টিটু) মৃত্যুর পর তোছলিমা রহমান ব্যবসা ও সংসারের হাল ধরেন। আতিকুর রহমান ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে মারা যান। তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে তোছলিমা সংসারের হাল ধরেন। একই সঙ্গে স্বামীর ব্যবসার দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নেন।

১৯৮৭ সালে মেহেরপুরের দৈনিক আজকের কাগজ-এ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেন আতিকুর রহমান। পত্রিকার পাঠকদের জন্য তিনি নিজেই পত্রিকাটি মেহেরপুরে আনতে শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের এজেন্ট হয়ে জেলায় পত্রিকার ব্যবসা শুরু করেন। মেহেরপুর জেলায় জাতীয় দৈনিক, মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার একমাত্র এজেন্ট ছিলেন তিনি। তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘পেপার হাউস’। নিজস্ব নিউ কাজলা পরিবহনের মাধ্যমে তিনি পত্রিকা পরিবহন করেছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর তোছলিমা রহমান পত্রিকা এজেন্ট হিসেবে এবং পত্রিকা পরিবহনের ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছেন। পড়ালেখা শিখিয়ে তিন মেয়ে এক ছেলেকে মানুষ করছেন। বর্তমানে মেহেরপুর শহরের শহীদ গফুর সড়কে নিজস্ব বাসভবনে বসবাস করছে তোছলিমার পরিবার। তোছলিমা রহমান স্বামীর আদর্শকে ধারণ করে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পত্রিকা ও পরিবহন ব্যবসা চালিয়ে যেতে চান।

তোছলিমার এইচএসসি পড়ুয়া মেয়ে রামিসা ফারিহা বলল,‘মা সংসার চালাচ্ছেন এটা নিয়ে আমরা গর্বিত।প্রথম দিকে এলাকার মানুষ বিষয়টি ভালো চোখে না দেখলেও এখন আর কিছু বলেন না।’

রুনা আকতার

পত্রিকার ব্যবসা ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন

স্বামীর মৃত্যুর পর পত্রিকার ব্যবসা আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন রুনা আকতার। ঝড়–বৃষ্টি উপেক্ষা করে করোনার সময়েও তিনি পত্রিকা পৌঁছে দিয়েছেন পাঠকের হাতে হাতে।

দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার পত্রিকার এজেন্ট রুনা আকতার সম্প্রতি স্বামীকে হারিয়েছেন। তাঁর স্বামী মোজাম্মেল হোসেন ছিলেন প্রথম আলোর এজেন্ট। কিডনির রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। রেখে যান দুই ছেলে আর স্ত্রীকে।

রুনা আকতার বলেন, ‘যত দিন বাঁচি, সততাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। ছেলে দুটিকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে পারলেই আমার দায়িত্বের বোঝা হালকা হবে।’ বড় ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র কামরুল হাসান রাসেল বর্তমানে ঢাকায় পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করছে। ছোট ছেলে রিফাত হাসান তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।

প্রথম আলোর একজন পাঠক বলেন, ‘রুনা আপা আমাদের প্রতিদিন সকালে পত্রিকা পৌঁছে দেন। অসুস্থতার দোহাই দিয়ে কোনো দিনও পত্রিকা দেওয়া থেকে বিরত থাকেননি।’

৩৫ বছর বয়সী রুনা বললেন,‘স্বামী মারা যাওয়ার আগে আমি কখনোই ব্যবসা সম্পর্কে খোঁজ নিতাম না। আর এখন এ ব্যবসাই আমার পরিবারকে ভালো রাখতে সহায়তা করছে। বাবার পরিবার, হকার এমনকি এলাকার লোকজনও আমাকে সহায়তা করছেন।’

সালমা বেগম

পত্রিকা বিক্রি করেই চলছে তাঁর জীবন

ব্যস্ত ঢাকা নগরের বিজয় সরণিতে লাল বাতি জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকা নিয়ে ছুটে আসেন ৬৫ বছর বয়সী সালমা বেগম। ভোর থেকেই যানজটে আটকে পড়া যাত্রীদের হাতে তুলে দেন পত্রিকা। জীবনসংগ্রামী সালমা বেগমের দেড় মাস বয়সে মা মারা যাওয়ার পর বরিশালে বাবার সংসারে অনেক কষ্টে বেড়ে ওঠেন। দিনমজুর আবদুল বারেক সরকারের সঙ্গে ১৮ বছর বয়সে বিয়ে দেয় পরিবার। কিছু দিন স্বামীর সংসারে সুখে কাটলেও অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাড়ি জমান। ঢাকায় এসে দুজনেই তিন–চার বছর দিনমজুরের কাজ করেন। আয়ের টাকা দিয়ে তিনি অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে দিনমজুরের কাজ করতে না পারায় প্রায় ৩০ বছর আগে স্বামী–স্ত্রী মিলে বিজয় সরণি সিগন্যালে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। তাঁদের তিন সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে বিয়ে করে বরিশালে দিনমজুরি করেন এবং মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ঢাকার আগারগাঁও তালতলায় দুজনে বসবাস শুরু করেন।

২০১৭ সালে স্বামী মারা গেলে একা হয়ে পড়েন সালমা বেগম। আবার একা জীবনসংগ্রাম শুরু হয় তাঁর, পত্রিকা বিক্রি করে জীবন চালাচ্ছেন। জীবনসংগ্রামে বারবার ঘুরে দাঁড়ানো সালমা বেগমের জীবনে আবার আঘাত হানে ২০২০ সালে করোনাভাইরাসে সারা দেশে কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হলে। বিধিনিষেধে রাস্তাঘাটে গাড়ি না চলায় পত্রিকা বিক্রি হতো না। ঢাকায় অনেক কষ্টে কিছুদিন কাটালেও বাধ্য হয়ে ফিরে যান বরিশালে ছেলেদের কাছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আবার তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন সালমা বেগম।

বাসনা দাশ

ঘর ও ব্যবসা দুটিই সামলাচ্ছেন বাসনা

ভোরেই রান্নার কাজ শেষ করেন। আটটায় ঘর গোছানো শেষ করে ছুটে যান ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। রাত ৯টা পর্যন্ত টানা ১৩ ঘণ্টা কাজ করে তারপর বাড়িতে ফিরে রাতের রান্না, খাওয়াদাওয়া শেষে ঘুম। এভাবেই দিন কাটছে বাসনা দাশের।

বাসনা রাঙামাটি শহরের বনরূপায় ‘পত্রিকার এজেন্ট ও বই একাডেমি’ নামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। গত বছরের ২৯ জুলাই তাঁর স্বামী বিকাশ চন্দ্র দাশ মারা যাওয়ার পর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই পড়ে। বিকাশ দাশ কয়েক যুগ ধরে পত্রিকা বিক্রির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন স্বামীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করছেন বাসনা দাশ।

বাসনা দাশ প্রথম আলোকে জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর খুব ব্যস্ত সময় কাটছে তাঁর। একসঙ্গে ঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সামলাতে হচ্ছে। কখনো আত্মীয়স্বজন ও মেহমান এলে আপ্যায়নের পাশাপাশি তাঁদের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘোরাতে হয়। কষ্ট হলেও বেশ ভালো আছেন তিনি।

বাসনার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েকে সম্প্রতি বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে নিলয় দাশ এইচএসসি পাস করেছে। বাসনার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ২ জন কর্মচারী ও ১২ জন হকার রয়েছেন। বই একাডেমির কর্মচারী সুলেশ চাকমা বলেন, ‘আমরা বই একাডেমিতে নিয়মিত দুজন কাজ করি। বর্তমান মালিক আমাদের খুব স্নেহ করেন। আমরাও তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করি।’