সেফ হোমের চিত্র

নামে নিরাপদ আবাস, বাস্তবে সবকিছুতে ঘাটতি

খাবারে প্রতি বেলা বরাদ্দ ২১ টাকা। আসনসংখ্যার চেয়ে বেশি নিবাসী ও জনবল ঘাটতি। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কাগজে–কলমে।

ফরিদপুরে সেফহোমের প্রধান ফটক
 ফাইল ছবি

নাম নিরাপদ আবাসন কেন্দ্র বা সেফ হোম। কাগজে-কলমে সুবিধা অনেক। সেফ হোম নিবাসী নারী ও শিশুদের সুরক্ষা দেয়। যত্ন নেয়, ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আছে। রয়েছে কাউন্সেলিংয়ের সুবিধা। সব মিলিয়ে মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়ে বিচারাধীন নারী-শিশুদের সমাজে পুনর্বাসন করে তারা।

বাস্তবে চিত্রটি পুরোপুরি ভিন্ন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন সেফ হোমগুলোতে এক বেলার খাবারের বরাদ্দ মাত্র ২১ টাকার মতো। থাকতে হয় গাদাগাদি করে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। পুনর্বাসন বলতে পরিবার অথবা নিজ জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া। নিরাপত্তার ঘাটতি ও জনবলের অভাব প্রকট।

এ পরিস্থিতি সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় পরিচালিত ৬টি মহিলা ও শিশু-কিশোরী হেফাজতিদের নিরাপদ আবাসন কেন্দ্রের। এসব কেন্দ্রের কর্মকর্তারাই বলছেন, কেন্দ্রগুলোতে নানা সমস্যা রয়েছে। ফলে যে উদ্দেশ্যে সেফ হোম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা পূরণ হচ্ছে না।

গত ৩০ ডিসেম্বরের হিসাবে, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন ছয়টি সেফ হোমে ৪২৯ জন নারী ও কিশোরী ছিল।

কারাগারের বাইরে সেফ হোমে রাখার উদ্দেশ্য হলো, নারী ও কিশোরীদের জেলখানার পরিবেশ থেকে মুক্ত করে সুন্দর পরিবেশে থাকা–খাওয়ার বন্দোবস্তসহ নিরাপদ রাখা। তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিচারাধীন মামলায় আদালতের নির্দেশে নারী ও শিশুদের সেফ হোমে রাখা হয়। এর বাইরে একইভাবে অভিভাবকহীন প্রতিবন্ধী এবং উদ্ধার করা নারী ও শিশুদের আদালতের নির্দেশে সেফ হোমে রাখে সমাজসেবা অধিদপ্তর। গত ৩০ ডিসেম্বরের হিসাবে, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন ছয়টি সেফ হোমে ৪২৯ জন নারী ও কিশোরী ছিল।

সেফ হোমগুলো প্রায়ই আলোচনায় আসে নিবাসীদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায়। গত ৫ ডিসেম্বর ফরিদপুর সেফ হোম থেকে সীমানাপ্রাচীর টপকে পালায় ১৪ থেকে ২১ বছর বয়সী সাতজন, যার মধ্যে চারজন তরুণী ও তিন কিশোরী। পরে দুজনকে উদ্ধার করে পুলিশ। বাকিদের এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এর আগেও বিভিন্ন সেফ হোম থেকে পালানোর ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সৈয়দ মো. নূরুল বাসির প্রথম আলোকে বলেন, সেফ হোমগুলোতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা দরকার। শুধু অবকাঠামো হতে হবে কারাগারের মতো সুরক্ষিত। এখন সেফ হোমগুলোতে অবকাঠামো ঘাটতি, জনবলসংকট ও বরাদ্দের স্বল্পতা রয়েছে। সরকার এ ঘাটতি দূর করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে।

সেফ হোমগুলো প্রায়ই আলোচনায় আসে নিবাসীদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায়। গত ৫ ডিসেম্বর ফরিদপুর সেফ হোম থেকে সীমানাপ্রাচীর টপকে পালায় ১৪ থেকে ২১ বছর বয়সী সাতজন, যার মধ্যে চারজন তরুণী ও তিন কিশোরী। পরে দুজনকে উদ্ধার করে পুলিশ। বাকিদের এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

গাদাগাদি করে থাকা

সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে এখন যে ছয়টি সেফ হোম আছে, তার স্থাপনা তৈরি হয়েছিল শান্তিনিবাসের জন্য। আধা পাকা টিনশেডের একতলার এসব স্থাপনায় প্রবীণেরা থাকবেন বলে কথা ছিল। যদিও প্রবীণদের রাখার পরিকল্পনা সফল হয়নি। পরে ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে শান্তিনিবাসগুলোকে সেফ হোমে রূপান্তর করে সরকার।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে ফরিদপুর, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও বাগেরহাটে প্রতিষ্ঠিত ছয়টি সেফ হোমে আসনসংখ্যা ৫০ করে মোট ৩০০। গত ৩০ ডিসেম্বরের হিসাবে, আসনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি নিবাসী সেখানে ছিলেন (৪২৯ জন)। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী নারী ও মেয়েশিশুর সংখ্যা ছিল ১৭৩।

ফরিদপুর সেফ হোমে দুই সপ্তাহের মতো থাকা এক কিশোরীর বাবা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, মেয়ে বের হয়ে জানিয়েছে, তাঁকে এক কক্ষে গাদাগাদি করে থাকতে হতো। খাবারের মান ভালো ছিল না। সেফ হোমের কাছেই বাসা থাকায় মেয়ের জন্য তিনি প্রতিদিন খাবার পাঠাতেন। খাবার তাঁর মেয়ের কাছে পৌঁছে দিত কর্তৃপক্ষ।

সেফ হোমগুলোতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা দরকার। শুধু অবকাঠামো হতে হবে কারাগারের মতো সুরক্ষিত। এখন সেফ হোমগুলোতে অবকাঠামো ঘাটতি, জনবলসংকট ও বরাদ্দের স্বল্পতা রয়েছে। সরকার এ ঘাটতি দূর করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে
সৈয়দ মো. নূরুল বাসির, সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান)

২১ টাকার খাবার

সেফ হোমে নিবাসীদের খাওয়া, চিকিৎসা, তেল, সাবান, ওষুধ, শিক্ষা প্রশিক্ষণ, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার জন্য জনপ্রতি বরাদ্দ সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে নিবাসীদের খাবার ও জ্বালানি ব্যয় বাবদ বরাদ্দ আড়াই হাজার টাকা। অর্থাৎ সকাল, দুপুর, বিকেল ও রাতের খাবারের জন্য দিনে বরাদ্দ ৮৩ টাকা। এতে প্রতি বেলার জন্য বরাদ্দ দাঁড়ায় ২১ টাকারও কম।

নিবাসগুলোতে ঠিকাদারের মাধ্যমে খাবার সরবরাহ করা হয়। ঠিকাদার তাঁর মুনাফাও ওই ২১ টাকার মধ্যেই ধরেন। এই সামান্য বরাদ্দ দিয়ে নিবাসী নারী ও কিশোরীদের ভালো ও উপযুক্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার দেওয়া সম্ভব হয় কি না, জানতে চাইলে ছয়টি হোমের দায়িত্বপ্রাপ্তরা জানান, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় এত কম টাকায় উন্নত মানের খাবার দেওয়া সম্ভব হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক নাজমা শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, পুষ্টির জন্য প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় দুধ, ডিম, ফলসহ বিভিন্ন খাবার রাখতেই হয়। শুধু বরাদ্দ নয়, পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। তিনি বলেন, সরকার সেফ হোমগুলোতে বরাদ্দ বাড়াতে পারলে সবচেয়ে ভালো। তবে এখন যেটুকু বরাদ্দ আছে, তা দিয়ে পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতে পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী তালিকা তৈরি করা দরকার।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে ফরিদপুর, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও বাগেরহাটে প্রতিষ্ঠিত ছয়টি সেফ হোমে আসনসংখ্যা ৫০ করে মোট ৩০০। গত ৩০ ডিসেম্বরের হিসাবে, আসনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি নিবাসী সেখানে ছিলেন।

নিরাপত্তার ঘাটতি

নিবাসী পালানোর ঘটনার জন্য সেফ হোমের নিরাপত্তাব্যবস্থার ঘাটতির কথা বলছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। তাঁদের দাবি, সেফ হোমের টিনের ছাউনির পাকা ঘরগুলোর চারপাশে দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। তবে দেয়াল খুব একটা উঁচু নয়। আবার নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁদের গাফিলতিও রয়েছে।

সরেজমিনে ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা এলাকায় ৫০ শতাংশ জমিতে প্রতিষ্ঠিত সেফ হোমে গিয়ে দেখা যায়, এটির চারপাশে ৫ ফুট উঁচু সীমানাপ্রাচীর রয়েছে। তার ওপরে ২ ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া। গত ৫ ডিসেম্বর এই দেয়াল টপকেই পালিয়েছিল সাতজন। এ সময় সেফ হোমের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দুই আনসার সদস্য ঘুমিয়ে ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, হোমগুলোতে ১০ জন করে নারী আনসার সদস্য এবং পুলিশের একজন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ও তিনজন কনস্টেবল হোমের ভেতর ও বাইরে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্বে অবহেলার বিষয়ে জবাবদিহির ক্ষমতা নিজ নিজ বাহিনীর হাতে থাকে।

ফরিদপুর সেফ হোমের উপতত্ত্বাবধায়ক রোমেনা আক্তার বললেন, সাত নিবাসী পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তিন কর্মচারীকে বদলি করা হয়েছে। সীমানাপ্রাচীর উঁচু করে ১৪ ফুট করার প্রস্তাব সমাজসেবা অধিদপ্তরে দেওয়া হয়েছে। প্রাচীরসংলগ্ন ৩০টি গাছ কেটে ফেলার জন্য বন বিভাগকে জানানো হয়েছে।

ফরিদপুরের ওই ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার দুই আনসার সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে জানিয়ে সেফ হোমটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট সদস্যদের কর্তৃপক্ষ সুপারিশ এখনো বাস্তবায়ন না করায় তাঁরা এখনো কর্মরত রয়েছেন।

সরকার সেফ হোমগুলোতে বরাদ্দ বাড়াতে পারলে সবচেয়ে ভালো। তবে এখন যেটুকু বরাদ্দ আছে, তা দিয়ে পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতে পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী তালিকা তৈরি করা দরকার।
অধ্যাপক নাজমা শাহীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক

পদ ৭৮টি, জনবল ৪৩ জন

সমাজসেবা অধিদপ্তরের একেকটি সেফ হোমে ১৩টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। সব মিলিয়ে ৬টি সেফ হোমে মোট পদ ৭৮টি। গত ৩০ ডিসেম্বরের হিসাবে ৩৫টি পদই খালি ছিল। সেফ হোমগুলোর ১৩টি পদ হলো একজন করে উপতত্ত্বাবধায়ক, খণ্ডকালীন চিকিৎসক, নার্স, ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর, দিনের নিরাপত্তাপ্রহরী, রাতের নিরাপত্তাপ্রহরী, গাড়িচালক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অফিস সহকারী এবং দুজন করে আয়া ও রাঁধুনি। এ ছাড়া জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের আওতায় দুজন সমাজকর্মী হোমগুলোতে দায়িত্ব পালন করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট সেফ হোমে দীর্ঘদিন ধরে ১৩টির মধ্যে ১০টি পদই খালি। উপতত্ত্বাবধায়ক, নার্স ও একজন নিরাপত্তাপ্রহরী নিয়েই চলছে হোমটি। ইউনিসেফের দুজন সমাজকর্মীর মধ্যে একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। এই সেফ হোমে প্রায় চার বছর ধরে উপতত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রুপন দেব প্রথম আলোকে বললেন, ‘নিবাসীরাই ভাগাভাগি করে শৌচাগার পরিষ্কার, রান্না করাসহ বিভিন্ন কাজ করেন।’

চট্টগ্রাম সেফ হোমে শূন্য পদের সংখ্যা ৮। উপতত্ত্বাবধায়ক পদটিও শূন্য। প্রেষণে একজন দায়িত্ব পালন করছেন এই পদে। খণ্ডকালীন চিকিৎসক, নার্স, ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর, অফিস সহকারী, গাড়িচালক এবং একজন নিরাপত্তাপ্রহরী ও একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদ খালি। বাগেরহাট সেফ হোমেও খালি পদের সংখ্যা ৮। উপতত্ত্বাবধায়ক দুজন আয়া, একজন নৈশপ্রহরী ও একজন রাঁধুনি নিয়ে হোমটি পরিচালনা করছেন। অন্য সেফ হোমগুলোতেও তিন-চারটি করে পদ খালি।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে সেফ হোমে নিবাসীদের কাউন্সেলিং সেবা দেওয়া হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কাউন্সিলরের কোনো অনুমোদিত পদ নেই। এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আলী আহসান বলেন, নিবাসীদের কাউন্সেলিং করার জন্য নির্ধারিত পদ থাকা খুবই প্রয়োজন।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের একেকটি সেফ হোমে ১৩টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। সব মিলিয়ে ৬টি সেফ হোমে মোট পদ ৭৮টি। গত ৩০ ডিসেম্বরের হিসাবে ৩৫টি পদই খালি ছিল।

প্রতিবন্ধীদের জন্য নেই আলাদা ব্যবস্থা

সেফ হোমে প্রতিবন্ধী নিবাসীদের দেখভালের জন্য আলাদা জনবল বা আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, মানসিক প্রতিবন্ধী নিবাসীদের নিয়ে তাদের ভয় বেশি থাকে।

গত ৩০ ডিসেম্বরের হিসাবে, রাজশাহী সেফ হোমে ১১০ নিবাসীর মধ্যে শুধু মানসিক প্রতিবন্ধী নিবাসীর সংখ্যাই ছিল ৫৮। এ ছাড়া বরিশাল সেফ হোমে ২৮, চট্টগ্রামে ১৮, ফরিদপুরে ২০ ও বাগেরহাটের সেফ হোমে ৪৪ জন প্রতিবন্ধী নারী ও শিশু ছিল।

বাগেরহাট সেফ হোমের উপতত্ত্বাবধায়ক অনিমা বাছার বলেন, ‘বদ্ধ জায়গায় থাকতে থাকতে অনেকে আরও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। আর এ ধরনের পরিবেশে থাকা সুস্থ–স্বাভাবিক নিবাসীদের জন্যও কষ্টকর হয়ে যায়।’

সেফ হোমে প্রতিবন্ধী নিবাসীদের দেখভালের জন্য আলাদা জনবল বা আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, মানসিক প্রতিবন্ধী নিবাসীদের নিয়ে তাদের ভয় বেশি থাকে।

পুনর্বাসন শুধু নামে

সেফ হোমের একটি দায়িত্ব হলো নিবাসীদের পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। তবে বাস্তবে পড়াশোনার জন্য কিছু বই ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেই। বেশির ভাগ হোমেই প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই। সুযোগ থাকলেও তা সেলাই-ফোঁড়ে সীমাবদ্ধ।

যেমন সিলেট সেফ হোমে ২০০২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মাত্র তিনজন নিবাসীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একজনের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। অভিভাবকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ১ হাজার ৮২৯ জনকে। আর নিজ জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয় ১৯২ জনকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয় ২৪২ জনকে।

সেফ হোমের উপতত্ত্বাবধায়কেরা জানান, প্রশিক্ষণ বা পড়াশোনার তেমন কোনো সুযোগ না থাকায় হোমে দীর্ঘদিন থাকার পরও কেউ স্বাবলম্বী হতে পারে না। হোমের পক্ষ থেকে একদম কারও কোনো যাওয়ার জায়গা না থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তবে এ সংখ্যা খুবই কম।

সেফ হোমের একটি দায়িত্ব হলো নিবাসীদের পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। তবে বাস্তবে পড়াশোনার জন্য কিছু বই ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেই।

গাজীপুরে নিবাসী কম

সমাজসেবা অধিদপ্তরের ছয়টি সেফ হোমের বাইরে মহিলা অধিদপ্তরের আওতায় গাজীপুরে ১ একর জমিতে ১০০ আসনের একটি সেফ হোম পরিচালিত হয়। সেখানে অবশ্য নিবাসীর সংখ্যা সব সময়ই কম থাকে। এ নিবাসে জনবল বা অবকাঠামোগত কোনো সমস্যা নেই। তবে বরাদ্দ অপ্রতুল।

এ সেফ হোমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরিদা খানম প্রথম আলোকে বলেন, হোমে নিবাসীদের মাসিক বরাদ্দ ২ হাজার টাকা। এটি বাড়াতে সুপারিশ করা হয়েছে।

অবশ্য এ সেফ হোম থেকেও পালানোর ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালে এ সেফহোম থেকে ১৭ জন নিবাসী পালায়। পরে ১২ জনকেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

সার্বিক বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় (২০১০-১৬) সেফ হোমগুলো পরিদর্শনে গিয়ে অপ্রতুল বরাদ্দ, জনবল–ঘাটতির মতো সমস্যাগুলো তাঁর নজরে এসেছিল। তখন মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে বরাদ্দ বাড়ানোসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়।

অধ্যাপক মিজানুর বলেন, নামে সেফ হোম হলেও আসলে নিবাসীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। একদিকে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী রেখে স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে, অন্যদিকে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাও তারা পাচ্ছে না। এভাবে চলতে পারে না। শুধু বরাদ্দ বাড়ানো নয়, এ ধরনের সেফ হোমে যে ধরনের সংবেদনশীল জনবল দরকার, তা নিয়োগ দিয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, ফরিদপুর)