মোবাইল আর্থিক সেবা মানুষকে দিয়েছে সাচ্ছন্দ্য
মোবাইল আর্থিক সেবা মানুষকে দিয়েছে সাচ্ছন্দ্য

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

নানা সম্ভাবনার পথ

গত এক দশকে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বাংলাদেশে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে, যা শুরু হয়েছিল ব্যাংকিং সুবিধার বাইরের সাধারণ মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে। এক দশকের মাথায় পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এ খাতের অন্যতম অংশীদার বিকাশ আজ আর শুধু গরিবের জন্য নয়, সমাজের গরিব-ধনী, নারী-পুরুষ, তরুণ-বয়স্ক, গ্রাম-শহরনির্বিশেষে অনেকেই আজ বিকাশ ব্যবহার করেন। যত মানুষ আমাদের সেবা নিচ্ছেন, ততই আমাদের দায়িত্ব বাড়ছে।

শুরুর দিককার এমএফএস অপারেটর হিসেবে বিকাশ এই খাতের ভিত্তি তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে যারা এমএফএস খাতে এসেছে, তারা এই তৈরি ভিত্তিটি পেয়েছে। আমরা এ বাস্তবতা স্বাভাবিক বলে মনে করি। দুটি বিষয়কে মাথায় রেখে বিকাশ বাজারে কাজ করে। প্রথমত, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও দ্বিতীয়ত, বিকাশের সেবার মান।

রপ্তানি ও পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের বেতন ও গরিব মানুষের জন্য সরাসরি সরকারি প্রণোদনা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা।

এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি লক্ষ্য অর্জন গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম, গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাঁদের স্বার্থ রক্ষার্থে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব বিধিমালা মেনে চলার ব্যাপারটি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়, বাজার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকদের মানসম্মত সেবা প্রদানের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। সেই সঙ্গে গ্রাহক ও দেশের স্বার্থে সাইবার নিরাপত্তা, গ্রাহকের আর্থিক নিরাপত্তা ও অ্যান্টি–মানি লন্ডারিং রোধে সব সময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। তৃতীয়, বিভিন্ন আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। কারণ, এর ফলে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা জামানতকারী তাঁর কষ্টার্জিত অর্থ বিকাশের মাধ্যমে ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করতে পারবেন, কোনো ব্যাংক শাখায় উপস্থিত না হয়ে। এই লক্ষ্যগুলো অর্জিত হলে নতুন সম্ভাবনার আরও পথে খুলে যাবে।

কোভিড পরিস্থিতি বিকাশকে তিনটি বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। প্রথম, আন্তর্জাতিক পরিসরে কোভিডের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য ছিল শিক্ষণীয় বিষয়। বিকাশে চীন ও আমেরিকান বিনিয়োগ থাকায় তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের জানার সুযোগ হয়। দ্বিতীয়, বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রক হিসেবে এমএফএস খাতকে সার্বক্ষণিক সেবা হিসেবে ঘোষণা করে, যা ছিল আপৎকালীন দেশের কাজে আসার বড় দায়িত্ব ও সুযোগ। তৃতীয়, সরকারের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া আর্থিক সহায়তা নির্ভুল ও দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ আসে। সে সুযোগ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার চেষ্টা করেছি।

কামাল কাদীর

সময়কে পেছনে ফেলে যতই আমরা সামনে এগিয়েছি, নতুন সব বাস্তবতা একে একে অভিজ্ঞতায় রূপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে চারটি শিক্ষণীয় দিকের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। এক. কোভিডসংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করাটি ছিল আমাদের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ। এই সময়ে বিকাশের কর্মীরা বাসায় বসে অনলাইনে গ্রাহকদের মানসম্মত সেবা দেওয়ার জন্য রাতদিন কাজ করেছেন। খরুচে অফিসের প্রয়োজনীয়তা কতটা, সেটা নতুন বাস্তবতা। দুই. ধারণা করা হচ্ছিল, টাকার মাধ্যমে কোভিড দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই আশঙ্কাকে বিবেচনায় রেখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা (এজেন্ট ও মাঠপর্যায়ের কর্মী) যেন জীবাণুমুক্ত পরিবেশে কাজ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করা। সে ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় দিকটি হলো, সরকারি সঠিক দিকনির্দেশনা ও ব্যক্তি খাতের আন্তরিক উদ্যোগ থাকলে অতি অল্প সময়ে আচরণগত সংস্কৃতি বদলানো সম্ভব। তিন. রপ্তানি ও পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের বেতন ও গরিব মানুষের জন্য সরাসরি সরকারি প্রণোদনা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিকাশ সর্বোচ্চ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যলেঞ্জ ছিল সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বাত্মক সহায়তা পাওয়া গেছে, যা দুর্যোগকালে সরকার ও ব্যক্তি খাতের পারস্পরিক আস্থা অর্জনের একটি ভালো দৃষ্টান্ত। চার. সামাজিক দায়বদ্ধতাকে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিতে রূপান্তর করে টেকসই সমাধান সম্ভব। দুর্যোগকালে বিকাশ সে পথ ধরে কাজ করেছে। প্রথম পর্যায়ে বিশেষ ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ ফ্রি করে দিয়ে; দ্বিতীয় পর্যায়ে লকডাউনকালে গরিব মানুষদের মধ্যে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে খাদ্যসহায়তা প্রদান; তৃতীয় পর্যায়ে আমাদের নিজ উদ্যোগে, বিনিয়োগকারীদের দেওয়া ভেন্টিলেটরসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের সহায়তা স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। দেশ ও দেশের মানুষের পাশে থাকার এ অভিজ্ঞতা, একটি গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভবিষ্যতে বিকাশের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

বিগত প্রায় সাত মাসে এমএফএস লেনদেন ওঠানামা করেছে, যা থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির একটি চেহারা পাওয়া যায়। এ ওঠানামার মধ্যে কয়েকটি লক্ষণ মোটা দাগে দেখা যায়। কোভিডের শুরুতে লকডাউনের কারণে গত মার্চে এসএফএস লেনদেন কমে যায়। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি চাঙা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেনদেনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় পর্যায়ে জুলাইয়ে এসে এমএফএস খাতে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়। তার কারণ ছিল ঈদ, বেতন-বোনাস ও বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সের টাকা একসঙ্গে এই সময়ে আসে, যা ছিল একটি ব্যতিক্রমী মাস। পরবর্তী সময়ে তৃতীয় পর্যায়ে, কোভিডের সঙ্গে মানুষ খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করেছে, সেই সঙ্গে এমএফএসও স্বাভাবিক লেনদেনে ফিরতে শুরু করেছে, যা আপাতত দেশের ও সবার জন্য আশার কথা। কোভিডকালীন নতুন বাস্তব পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের সঙ্গে সমতালে পা ফেলে আমাদেরও কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হয়েছে ও হচ্ছে।

কোভিড ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ভিত্তিটি বিশ্বজুড়ে শক্ত করে দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সত্য। এ কোভিড পরিস্থিতিতে পড়ে মানুষ ডিজিটাল সার্ভিস ব্যবহার করতে অনেক বেশি উৎসাহিত ও সাহসী। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেন ডিজিটালি করতে আগে যে গড়িমসি ছিল, এখন তা অনেক বেশি বেগবান। কোভিড সময়ে গড়ে ওঠা মানুষের এ অভ্যাস এমএফএস ব্যবহারকারীরা তাঁদের আচরণে ধরে রাখবেন, এমনটা মাথায় রেখে এমএফএস ইকো সিস্টেম গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি হবে, এমন ভরসা রাখতে চাই। আর বলব, যতক্ষণ পর্যন্ত না সারা দেশে সার্বিক অর্থে ডিজিটাল পেমেন্টে সবাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত ক্যাশ টাকা লাগবে এবং তার জন্য শক্তিশালী এজেন্ট নেটওয়ার্কের ধারাবাহিকতা আবশ্যক। তাঁদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব আমাদের ও নীতিনির্ধারণকারীদের।

কোভিডকালে বিকাশের ওপর আমাদের গ্রাহক, ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ও সরকার যে আস্থা রেখেছে—সবার এ আস্থাকে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিই। ভবিষ্যতে এ আস্থা ধরে রেখে আমরা কাজ করে যেতে চাই। তবে এ ক্ষেত্রে বিরাটসংখ্যক সাধারণ গ্রাহকের অর্থের নিরাপত্তার স্বার্থে, এমএফএস খাতের সঙ্গে যুক্ত এমএফএস অপারেটর ও রেগুলেটরদের শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক। সেই সঙ্গে সরকার যেহেতু সামাজিক সুরক্ষার খাতের নগদ প্রণোদনা এবং নানা ধরনের বৃত্তি ও ভাতা এমএফএসের মাধ্যমে উপকারভোগীদের পৌঁছে দিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে উপকারভোগীদের এমএফএস অপারেটরদের স্বাধীনভাবে বাছাই করার সুযোগ দিতে হবে, যা এমএফএস খাতের মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ও গ্রাহকের সেবার মান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। তা না হলে এ খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভুল বার্তা দেওয়া হবে।


কামাল কাদীর প্রধান নির্বাহী, বিকাশ