নাইকোর সঙ্গে চুক্তির ধারাই 'গলার কাঁটা'

কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে সরকার তথা বাপেক্স কয়েকটি প্রান্তিক গ্যাসক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগে কাজ করার যে চুক্তি করেছিল, তার একটি ধারাই এখন সরকারের গলার কাঁটা। বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের (ইকসিড) সর্বশেষ শুনানিতে ওই ধারা উল্লেখ করে নাইকো টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের দায় থেকে মুক্তি চেয়েছে।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গত ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ওই শুনানি হয়। তাতে নাইকোর পক্ষের আইনজীবীরা নাইকো-বাপেক্স যৌথ উদ্যোগ চুক্তির ২৭.২ নম্বর ধারাটি উল্লেখ করেন। ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ধরনের দুর্ঘটনা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য দুই পক্ষের কেউ কাউকে দোষারোপ বা অভিযুক্ত করবে না।
পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, শুনানিতে এই ধারা উল্লেখ করার পর এ বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত যে ইকসিডের রায় নাইকোর পক্ষেই যাবে। নাইকো ইকসিডে ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল একটি এবং ১৬ জুন আরেকটি মামলা করে। মামলা দুটিতে নাইকো দুটি বিষয়ে আদেশ চায়। এক. টেংরাটিলায় বিস্ফোরণের দায় তাদের ওপর বর্তায় কি না এবং বাংলাদেশ ও পেট্রোবাংলা এ জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে কি না। দুই. ফেনী ক্ষেত্র থেকে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম পরিশোধ পেট্রোবাংলা বন্ধ রাখতে পারে কি না।
এর মধ্যে ফেনী থেকে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম পরিশোধের বিষয়ে ইকসিড আগেই রায় দিয়েছে। তাতে ওই দাম বাবদ নাইকোর প্রাপ্য অর্থ (সুদাসলে প্রায় ২১৬ কোটি টাকা) তৃতীয় কোনো হিসাবে রাখার জন্য বাপেক্সকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু এই অর্থ পরিশোধে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তা করা সম্ভব হয়নি। এবারের শুনানিতে সে বিষয়টি ইকসিডকে জানানো হয় এবং ক্ষতিপূরণ দাবির বিষয়ে অধিকতর শুনানি হয়। তাতে নাইকো চুক্তির উপরিউক্ত ধারা উল্লেখ করে দায়মুক্তি চায়।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শুনানির পর প্রশ্ন উঠেছে, যেকোনো চুক্তিতে ওই ধরনের ধারা কীভাবে সন্নিবেশিত হতে পারে। নাইকোর সঙ্গে ওই চুক্তিটি অনেকটাই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হওয়ায় ২৭.২ ধারার মতো বিষয় কর্মকর্তারা দেখেও দেখেননি।
প্যারিস শুনানির পর মামলায় সরকারপক্ষের আইনজীবীরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন, ওই ধারাটির বলে মামলায় নাইকো আদালতের সহানুভূতি পেতে পারে। এ ছাড়া সরকারকে তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন যে বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে টেংরাটিলায় ক্ষয়ক্ষতির যে নিকাশ করা হয়েছে, তার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আদালতে নাইকোর বিরুদ্ধে মামলা করার।
এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের করা ক্ষয়-ক্ষতি নিকাশের প্রতিবেদন এই মাসের মাঝামাঝি (১৫ মার্চ নাগাদ) পাওয়া যাবে। তারপরই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
টেংরাটিলা বিস্ফোরণে নাইকোর দায় প্রমাণের জন্য সরকার আইনজীবীর পরামর্শেই অকুস্থলে একদল বিদেশি বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে সেখানকার সার্বিক অবস্থার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তথ্য সংগ্রহ করিয়েছে। তা ছাড়া নাইকোর সঙ্গে বিভিন্ন সময় বাপেক্সের টেংরাটিলা-বিষয়ক আলোচনার প্রামাণ্য তথ্যও সংগ্রহ করেছে ওই বিশেষজ্ঞ দল।
নাইকোর অদক্ষ খনন-প্রক্রিয়ার কারণে ২০০৫ সালে দুবার (৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন) টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটে। এর ফলে ওই গ্যাসক্ষেত্র, সন্নিহিত এলাকায় পরিবেশ ও জনজীবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সরকার তথা পেট্রোবাংলা প্রথমে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করে। কিন্তু তা সফল না হওয়ায় ২০০৮ সালে ঢাকার দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ৭৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করে। আর নাইকো ইকসিডে মামলা করে ২০১০ সালে।