একাত্তরের নভেম্বর থেকে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে। আজ পড়ুন নরসিংদীর কাহিিন
‘বজ্রকণ্ঠে সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশ—“ফায়ার”। মুহূর্তের মধ্যে গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধাদের আগ্নেয়াস্ত্র। গুলির শব্দে চকিতে পজিশন নিয়ে নেয় পাকিস্তানি সেনারা।’
নরসিংদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের বর্ণনা দিচ্ছিলেন নরসিংদী সদর থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মুহাম্মদ ইমাম উদ্দিন। জায়গাটা নরসিংদীর জিনারদী। মুক্তিসেনাদের তীব্র হামলার মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ২১ পাকিস্তানি সেনা।
১২ ডিসেম্বরের ওই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সিরাজ উদ্দিন বীর প্রতীক। তিনি এলাকায় ‘ন্যাভাল সিরাজ’ নামে পরিচিত ছিলেন। তৎকালীন নৌসেনা সিরাজ উদ্দিন ছুটিতে এসে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
সেদিন সিরাজ উদ্দিনের পাশে থেকে লড়াই করেছিলেন মুহাম্মদ ইমাম উদ্দিন। প্রথম আলোর কাছে তিনি বর্ণনা করেন সেদিনের লড়াইয়ের কথা।
যুদ্ধের শুরু থেকেই নরসিংদীতে হানাদার বাহিনীকে চাপের মুখে রাখেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিসেনাদের তৎপরতার কারণে ঠিকমতো বিশ্রামও নিতে পারেননি তাঁরা, বলছিলেন ইমাম উদ্দিন। যেদিন বড় ধরনের কোনো হামলার পরিকল্পনা থাকত না, সেদিনও কোনো না কোনো মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙ্কারের কাছে গিয়ে গুলি ছুড়ে আসতেন। উদ্দেশ্য, শত্রুদের তটস্থ রাখা। ফলও মিলছিল। সন্ত্রস্ত পাকিস্তানি সেনারা দিন-রাত উদ্ভ্রান্তের মতো লক্ষ্যহীন গুলি ছুড়ত।
ইমাম উদ্দিন বলেন, মুক্তিসেনাদের বিরামহীন আক্রমণের মুখে ৮ ডিসেম্বর নরসিংদীর বেশির ভাগ জায়গা থেকে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। নরসিংদী সদরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পাকিস্তান বাহিনীর কিছু সদস্য।
১১ ডিসেম্বর শিবপুরের মজনু মৃধার নেতৃত্বে উড়িয়ে দেওয়া হয় নরসিংদী শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। চারদিক থেকে তখন আসছিল বিজয়ের বার্তা। খবর আসে, আখাউড়া ও ভৈরবের যুদ্ধ শেষ করে সামনে এগিয়ে চলেছে মিত্রবাহিনী। মনোবল তুঙ্গে উঠে যায় মুক্তিসেনাদের।
ইমাম উদ্দিন জানান, ১২ ডিসেম্বর সকাল নয়টার দিকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ভাটপাড়া গ্রামে অবস্থান করছিলেন। খবর আসে, ভারী অস্ত্রে সজ্জিত একদল পাকিস্তানি সেনা তল্পিতল্পা গুটিয়ে পাঁচদোনা থেকে পালাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় ধরে এগোচ্ছিল তারা। লক্ষ্য নরসিংদী শহর থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে জিনারদী রেলস্টেশন। ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযোদ্ধারা। পালাতে দেওয়া যাবে না হানাদারদের। দ্রুত জিনারদী পাটুয়া এলাকায় অবস্থান নেন তাঁরা। তখন সকাল ১০টার মতো। হানাদারদের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষা। মিনিট পনেরোর মধ্যে ২১ পাকিস্তানি সেনা পাটুয়ার মোল্লা বাড়ির পাশে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের আওতায় চলে আসে। সিরাজ উদ্দিনের নির্দেশে গুলি ছুড়তে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। শুরু হয় তুমুল লড়াই।
ঘণ্টাব্যাপী ওই যুদ্ধে দুজন পাকিস্তানি সেনা গুলিবিদ্ধ হয়। একে একে সবাই আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধারা। বের হয় বিজয় মিছিল। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে থাকা বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল পত পত করে।
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নরসিংদী প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান}