গত শুক্রবার রাতেও রাজধানীর সড়কে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। নভেম্বরে শুধু ঢাকায় মারা গেছেন ১৬ জন।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু থেমে নেই। চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৩৭ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে নভেম্বর মাসে মারা গেছেন ৫৪ জন শিক্ষার্থী। সড়কে মৃত্যুর এই তথ্য রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের।
নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা এই সংগঠন সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনার মাসওয়ারি হিসাব রাখে। সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের তথ্যের ভিত্তিতে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তৈরি করে সংগঠনটি। সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১১ মাসে মোট ৪ হাজার ২৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ১৪৪ জন। এর মধ্যে শিক্ষার্থী ১৪ শতাংশ।
ট্রাক ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার ঊর্ধ্বমুখী হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থার উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে।রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান
গত শুক্রবার রাতেও রাজধানীর সড়কে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মাহাদী হাসান (২১)। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিমানবন্দর এলাকায় কনটেইনারবাহী কাভার্ড ভ্যানের চাপায় মোটরসাইকেল–আরোহী মাহাদী নিহত হন। তিনি গ্রিন ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
গত ১৮ নভেম্বর থেকে বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে বিক্ষোভ করছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ২৪ নভেম্বর গাড়িচাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর তা রূপ নেয় নিরাপদ সড়কের ৯ দফা দাবির আন্দোলনে। এর মধ্যে ২৯ নভেম্বর রাতে রামপুরায় বাসচাপায় মারা যায় এসএসসি পরীক্ষার্থী মাইনুদ্দিন ইসলাম।
গতকাল শনিবারও নিরাপদ আন্দোলনের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা সড়কে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লাল কার্ড দেখিয়েছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাক ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার ঊর্ধ্বমুখী হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থার উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে।
গত শুক্রবার রাতে সড়কে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মাহাদী দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয়। মাহাদী মা ও ভাইয়ের সঙ্গে উত্তরার কামারপাড়া এলাকায় থাকতেন। তাঁর বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। মাহাদী ধানমন্ডিতে এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখে রাতে কামারপাড়ায় ফিরছিলেন।
মাহাদীদের বাড়ি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার দমদমা পশ্চিম গ্রামে। বাবা মোফাজ্জল হোসেন সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট ছিলেন। অবসরের পর তিনি চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি ব্যাংকের নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেন।
মাহাদীর বাবা মোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে জানান, মাহাদীর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস মিরপুরে। তাঁর মোটরসাইকেলের শখ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার সুবিধার্থে তাঁকে দেড় বছর আগে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কিনে দেন। মোটরসাইকেল কেনার জন্য গ্রামের বাড়ির দুই বিঘা জমি তিনি বন্ধক রাখেন।
ঢাকা বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী কায়কোবাদ প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাটি মধ্যরাতের। মাহাদী হাসান নামের ওই তরুণ ঘটনাস্থলেই মারা যান। তাঁকে উদ্ধার করে শুক্রবার দিবাগত রাত পৌনে দুইটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়। দুর্ঘটনার পর চালক পালিয়ে যান। কাভার্ড ভ্যানটি জব্দ করা হয়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে দেশে ৩৭৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১৩ জন। গড়ে প্রতিদিন মারা গেছেন ১৪ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ৬৭ জন। শিশু ৫৮টি। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। নভেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধে৵ ৫৪ জন শিক্ষার্থী। এর আগে গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১১৮ শিক্ষার্থী।
নভেম্বর মাসে রাজধানী ঢাকায় ১৪টি দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম প্রাণহানি হয়েছে বরিশাল বিভাগে। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রাম জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে।
গত ২৪ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় মৃত্যু হয় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের। তার বড় ভাই মুনতাসীর মামুন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যার যায় সেই বোঝে কষ্টটা। আমাদের পুরো পরিবার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বিশেষ করে বাবা–মা একেবারে ভেঙে পড়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া প্রতে৵ক ব্যক্তির পরিবারই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকে।’
তথ্য বলছে, নভেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৪ শতাংশই ছিলেন মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী। ২৩ শতাংশ ছিলেন পথচারী। আর যানবাহনের চালক ও সহকারী ছিল ১৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মুখোমুখি সংঘর্ষ ও নিয়ন্ত্রণ হারানোয়। এসব দুর্ঘটনায় যানবাহন হিসেবে মোটরসাইকেল, ট্রাক ও বাস বেশি সম্পৃক্ত ছিল।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ, দক্ষ চালক তৈরি, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলের জন্য সার্ভিস রোড নির্মাণ করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের চলাচল বেশি থাকায় দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিসংখ্যানে তাঁদের সংখ্যা বেশি। পুরো সড়ক ব্যবস্থাপনা বদলাতে উদ্যোগ না নেওয়া হলে এই বিশৃঙ্খলা থেকে বের হওয়া যাবে না। শৃঙ্খলা শুধু টাকা-পয়সার বিষয় না, সুশাসনের বিষয়। সড়ক খাতে শৃঙ্খলা আনতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।