১০ ডিসেম্বর ২০১৫, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থান, কী চেয়েছি কী পেয়েছি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।
আলোচনায় সুপারিশ
* নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য সফল করার জন্য কার্যকর গণতন্ত্রে ফিরে আসা একান্ত প্রয়োজন
* জিয়া ও এরশাদের সময়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। অথচ গণতান্ত্রিক সরকারের সময় এটা বন্ধ আছে। এই নির্বাচন অবশ্যই ফিরিয়ে আনেত হবে
* নূর হোসেনের মূল চেতনা ছিল স্বৈরতন্ত্রের নিপাত। কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে স্বৈরতান্ত্রিক ধ্যানধারণা রয়ে গেছে। যেকোনো মূল্যে এটাকে দূর করতে হবে।
* গত ২৫ বছরে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের আজ ২৫ বছর পূর্ণ হলো। সেই গণ-অভ্যুত্থানের সূচনায় ছাত্রনেতৃত্বই ছিল প্রধান। তাঁদের অগ্রবর্তী অবদান ছাড়া আমাদের গণতন্ত্রের অর্জনটা আরও বিলম্বিত হতে পারত।
আন্দোলনে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও সবার একটা লক্ষ্য ছিল—স্বৈরাচারের পতন। এ আন্দোলনে সে সময়ে শহীদ হন সেলিম, জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালি, দেলোয়ার, তাজুল, জিহাদ, ময়েজউদ্দিন, বসুনিয়া, ডা. মিলন, নূর হোসেনসহ অনেকে।
স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে অর্জন করতে চেয়েছিলাম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব ধরনের উন্নয়ন। স্বৈরাচার পতনের ২৫ বছরে আমরা ফিরে দেখতে চাই আমাদের সে লক্ষে্যর কতটুকু অর্জিত হয়েছে, কতটুকু হয়নি। কেন হয়নি। সবাই নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থান িনয়ে আলোচনা করব। আজ এর বাইরে যেতে চাই না। এখন আেলাচনা করবেন নাজমুল হক প্রধান
নাজমুল হক প্রধান: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের স্লোগান ছিল গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সব বদলে গেল। রাজনীতিতে এল বহুদলীয় গণতন্ত্র ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধের পর যে রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ ছিল, সেই দলগুলোও রাজনীতি করার সুযোগ পেল। শাহ আজিজের মতো একজন মানুষ তখন প্রধানমন্ত্রী হলেন। এরই মধে্য আবার জিয়াউর রহমান নিহত হলেন।
অবৈধভাবে ক্ষমতায় এলেন এরশাদ। এরশাদ আসার পর তখন যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, সেই দলের ১৩০ সাংসদ এরশাদকে সমর্থন দিলেন। আমরা ছাত্রসমাজ ভাবলাম, এর বিরুদ্ধে কথা বলা দরকার। কিন্তু তখন আবার এমন নির্দেশনা বহাল ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্রে পাঁচজনের বেশি কথা বলা যাবে না, হাঁটা যাবে না।
প্রথম, ১৪ বা ১৭টি ছাত্রসংগঠন ছিল। সবার মাঝেই তখন কীভাবে এরশাদবিরোধী কথা শুরু করা যায়, এই নিয়ে একটা আলোচনা ছিল। আমি ছিলাম ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক। বুয়েটের এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো ১৭ সেপ্টেম্বর আমরা তৎকালীন মজিদ খানের শিক্ষানীতি নিয়ে একটি বিবৃতি দেব। বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্রে অনেকে মিলে হাঁটব। আমরা ঠিক তা-ই করলাম।
তখনো বিভিন্ন দেশে সামরিক শাসন ছিল। আনোয়ার ভাই আমাকে বললেন, ‘কাল সকালেই আমরা এই সামরিক শাসন নিয়ে একটা পোস্টার প্রদর্শনী করতে চাই। আপনি আর কাবুল জানবেন, আর কেউ নয়।’ কাবুল পড়ত ইতিহাস বিভাগে। কাবুল আমাকে জানাল, আমরা সকাল সাতটার মধ্যেই সব কাগজপত্র নিয়ে তৈরি থাকব। সকাল আটটায় তো আমাদের ক্লাস শুরু, এর আগেই আমরা পোস্টার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে ফেলব।
সকালে গিয়ে দেখি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টির ভেতরে পুলিশ। তো কাবুল ভাই তখন লাইব্রেরির পাশে ঘুরঘুর করছেন। একটাই প্রশ্ন, আর্টস ফ্যাকাল্টি ঘিরে তো পুলিশ, কী করি? আমি বললাম, চলো, দেখি কী করা যায়? আমি পুলিশদের বললাম, আপনারা এখানে কেন? আপনাদের দায়িত্ব তো বাইরে, এখানে কী করছেন? আমাদের ক্লাস করতে দেন। তখন পুলিশরা কী মনে করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল।
এই ফাঁকে আমরা দেয়ালজুড়ে পোস্টার লাগিয়ে দিই। প্রতিক্রিয়া এমন হলো, শিক্ষার্থীরা বোধ হয় এমন দৃশ্য আগে দেখেনি। তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও দাঁড়িয়ে দেখছি, মনে হয় পাঁচ মিনিট হলো। প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর দেখা হয়ে গেল। পরক্ষণেই পুলিশ এসে সব পোস্টার ছিঁড়ে ফেলল। পরে নেতারা এলেন। বিভিন্ন বিষয়ে কথা হলো। আমরা পুরো ক্যাম্পাসে হাঁটলাম। এই হলো আন্দোলনের সূত্রপাত।
এরপর ৭ নভেম্বর আমরা কর্নেল তাহের দিবস পালন করি। এদিন মিছিল করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে কিছু কিছু পার্টির সঙ্গে আমাদের কথা ছিল, মিছিলে হামলা হলে কী করা হবে। এর মাঝে আবার পুলিশ এসে বলে গেল—মিছিল করা চলবে না। কিন্তু আমরা মিছিল শুরু করে দিলাম। মধুর ক্যানটিন থেকে বেরিয়ে আমরা ডাকসু পর্যন্ত যেতে না যেতেই পুলিশের হামলা। চলল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। আমি, নুরুল আমিন ব্যাপারীসহ অনেকেই আহত হলাম। এভাবেই শুরু হলো আন্দোলন।
আমাদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, অবৈধ সামরিক শাসনের অবসান ও বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় নিয়ে যাওয়া। ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলা। অথচ নব্বই-পরবর্তী সরকার গঠনে বিএনপি তার দলে ঠাঁই দিল জামায়াতকে। এটা কি নব্বইয়ের চেতনাকে আঘাত করল না? শুধু কি তাই? ‘কী চেয়েছি আর কী পেয়েছি’—এই হিসাব করলে উঠে আসে আরও অনেক কিছুই।
নব্বই-পরবর্তী সময়েই তো হলো ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, মসজিদ-মন্দির-গির্জায় হামলা, রমনার বটমূলে হামলাসহ আরও কত কী সাম্প্রদায়িক অসংগতি।
শামসুজ্জামান দুদু: আলোচনা ২৫ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা কঠিন। আমরা দুবার স্বাধীনতা পেয়েছি, দুবার গণ–অভ্যুত্থানের ইতিহাস রচিত হয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ ফলাফল হলো, ভোট দেওয়ার অধিকার হারিয়েছি। যা কিছু ঘটেছে তা সবই ৬৮ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশের উদয় গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য।
যদি ভূভারতের কথা চিন্তা করি, দেখব যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের মানুষ হিসেবে না দেখে শুধু বাঙালি হিসেবে দেখেছেন। আক্ষেপ থেকে, যন্ত্রণা থেকে তিনি হয়তো এই কথা বলেছেন। কিন্তু আমি মনে করি, বাঙালি হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সংগ্রামী জাতি।
সুভাষচন্দ্র বসু লড়াই করে মুক্তি চেয়েছিলেন ভারতবর্ষের। ১৯৪৭-এর পর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছি। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো মানুষ পেয়েছি। শহীদ জিয়াউর রহমানসহ এক ঝাঁক বীর উত্তম, বীর বিক্রম আমরা পেয়েছি। কিন্তু মরীচিকার মতো থেকে গেছে গণতন্ত্র। যদি বাহাত্তর ও পঁচাত্তরের কথা বলি, আমরা সেখানেও রক্তের সাগর পেরিয়ে আবার গণতন্ত্র পেয়েছি। আমরা কোনোভাবেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট এড়িয়ে যেতে পারি না। এটি এক মর্মান্তিক অধ্যায়, একে পাশ কাটানোর কোনো সুযোগ নেই।
যে নেতৃত্বকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব বলছি, যেটি ওই দিন এক মর্মান্তিক অবস্থার মুখোমুখি হয়। এটা কার জন্য? জাসদের জন্য? ভাসানী ন্যাপের জন্য, আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্টদের জন্য? নাকি তৎকালীন যাঁরা শাসনব্যবস্থায় ছিলেন তাঁদের ভুল নীতির কারণে? এই নিয়ে অবশ্য খুব কম গবেষণা হয়েছে।
বারবার গণতন্ত্রে ফেরার আকাঙ্ক্ষা—রক্ত দিই, জেল খাটি, ফাঁসির মঞ্চে যাই। আবার গণতন্ত্র আমরা মরীচিকার মতো হারিয়ে ফেলি। এখন যেকোনো সুস্থ মানুষই বলবে, দেশে ভোটাধিকার প্রয়োগের অবাধ পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন আছে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। সেদিন বাংলার বাণী পত্রিকা একে সমর্থন জানিয়ে লিখেছিল, একটি গুলিও ফোটেনি এক ফেঁাটা রক্তও ঝরেনি। হে সামরিক শাসন তোমাকে অভিনন্দন। এ ধরনের মানসিকতা আমােদর। আমরাই আবার তঁার বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় বছর আন্দোলন–সংগ্রাম করেছি।
১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নব্বইয়ের নির্বাচিত সরকারকে টেনেহিঁচড়ে নামানোর জন্য আওয়ামী লীগ, জামায়ােত ইসলামী, এনডিপি, জাতীয় পার্টি আন্দোলন করে। সত্যটা আমরা বলি না। যে যার অবস্থানে থেকে প্রতারণা করছি। ছাত্ররাজনীতি এখন আছে বলে মনে হয় না। শ্রমিক রাজনীতি এনজিওভিত্তিক হয়েছে। এ দুটো রাজনীতি যখন শেষ হয় তখন আর জাতীয় রাজনীতি থাকে না।
পাকিস্তানের প্রেক্ষাপট শেখ মুজিবকে তৈরি কেরছে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নয় বছরের সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপটে বেগম খালেদা জিয়ার অাগমন। িজয়াউর রহমান তঁাকে হাত ধরে রাজনীতিতে আনেননি। তঁার অনেক সমালোচনা করা যাবে। কিন্তু নব্বইয়ের গণ–আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিকে একটি জায়গায় দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। খালেদা জিয়ার সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন করেছিলেন। এটি বাতিল হলো। আমরা ছাত্ররা কেউ কোনো প্রতিবাদ করিনি।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ফিরে পাওয়া, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ভোটাধিকার প্রয়োগ, নিরাপত্তা—এই পাঁচটি বিষয়ের বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল, পঁচিশ বছর পর ফিরে দেখি এর একটিও আর অবশিষ্ট নেই। সবশেষে বলব, আমরা এমন একটা জায়গায় আছি, যেখানে আইয়ুব খান যা বলতেন, এখন আমরা সেটাই বলছি। আইয়ুব খান বলতেন, ‘প্রথমে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’। আইয়ুব খান রাস্তাঘাট, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ অনেক উন্নয়ন করেছিলেন। কিন্তু উন্নয়ন তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি।
আজ আবার যাঁরা পুরোনো তত্ত্বের ভেতরে থেকে গণতন্ত্রকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছেন, গত ৬৮ বছরে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের দোহাই দিয়ে বলব, আসুন আমরা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য সফল করার জন্য গণতন্ত্রে ফিরে আসি।
আবদুল্লাহ আল কাফি: শুরুটা ছিল শিবলী কাইয়ুম স্বৈরশাসনবিরোধী পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া। পোস্টারে লেখা ছিল, ‘এই সামরিক শাসন মানি না’।
সেখানে ছাত্ররা তাঁদের ১০ দফা দাবি দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলো দিল পাঁচ দফা, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ তাদের পাঁচ দফা দিয়েছে। সম্মিলিত পেশাজীবী আন্দোলন, কৃষিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সর্বস্তরের লোকজন আন্দোলন করেছেন।
এখানে সবকিছু ছাপিয়ে প্রধান দলগুলোর একটা দাবি মুখ্য হয়ে দাঁড়াল, ‘এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি!’ এই আন্দোলনে ছাত্র হিসেবে আমাদের দশ দফা ছিল। যার প্রথম তিনটিই ছিল ছাত্রদের অধিকার ও শিক্ষার দাবি। বাকি সাতটি ছিল সমাজকে গণতন্ত্রায়ণ করাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে। যা কিনা সর্বশেষে তিন জোটের রূপরেখায়ও সন্নিবেশিত হয়েছিল।
ছাত্রদের প্রধান দাবি ছিল মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল করতে হবে। গত ২৫ বছরে এর কিছু বিষয় বাস্তবায়িত হয়েছে। অনেকগুলো হয়নি।
যে মজিদ খানের শিক্ষানীিতর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয়েছিল সেই মজিদ খানকেই ১৯৯২ সালে প্রথম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দেওয়া হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ১৭ থেকে ১৮টি নির্বাচন হয়। কিন্তু গত ২৫ বছরে দুটি নির্বাচন হয়নি। একটা ছাত্র সংসদ নির্বাচন, আরেকটি সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন। জিয়া ও এরশাদের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। যাদের আমরা গণতান্ত্রিক সরকার বলছি, তাদের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি।
ক্ষমতাসীন দলগুলোর পক্ষ থেকে ছাত্ররাজনীতিকে ভীষণভাবে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। কন্ট্রাক্টর, ঠিকাদার এঁরা আজকে ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে আছেন। তিন জোটের রূপরেখায় ভোটাধিকারসহ অনেকগুলো দাবি ছিল, সেগুলো মোটেই বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষ করে মাগুরা নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
১৯৯৬ ও ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। এবারের পৌরসভা নির্বাচনে একজন মেয়রসহ অনেক কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন। এটা কিন্তু একটা ভয়ংকর দিক। এবার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেমন হয়েছে, অামরা সবাই জানি। এই প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ক্ষেত্রে আত্মহত্যার শামিল।
কেন নব্বইয়ের লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয়নি। দুটো বৃহৎ রজনৈতিক দল জনগণের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। আমাদের বামপন্থী দলগুলোর বিপর্যস্ততা। নব্বইয়ের আন্দোলনে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের অনেকেই নীতি ও বিশ্বাস পরিবর্তন করেছেন। এমন অসংখ্য কারণে আজ ২৫ বছর পর অনেক বড় প্রশ্ন, কী চেয়েছি কী পেয়েছি।
মোশরেফা মিশু: ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া শেষে গ্রামের বাড়িতে গেলাম। ২৪ মার্চের সকাল বেলা, বাংলাদেশ বেতারে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের ঘোষণা শুনলাম। ঢাকায় এসে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনেও যোগ দিলাম। একে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান বললেও অত্যুক্তি হবে না।
ছাত্ররাই প্রথম মজিদ খানের শিক্ষানীতি বর্জনের মধ্য দিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। আমরা মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের দিকে যাচ্ছি। আকস্মিক গুলিতে লুটিয়ে পড়ল জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালি সাহা। আমাদের সঙ্গের এতগুলো প্রাণ ঝরে পড়তে দেখে নিজেদের বড় অসহায় মনে হচ্ছিল। আর তখনই আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে গেল যে এই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই হবে।
সংবিধানের মূল চেতনা ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতা হারাতে থাকে। এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম বিল পাসের মধ্য দিয়ে সেটি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যা পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।
সেদিন বিশ্বাসঘাতক জামায়াতও কীভাবে যেন আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে ঢুকে পড়ল। এটিকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। আশির দশকের সেই আন্দোলনের পাশাপাশি দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখি রাজনৈতিকভাবে জামায়াতের উত্থান। এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এই সাম্প্রদায়িক যুদ্ধাপরাধী শক্তির বিরুদ্ধে যেমন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল, আমরা সবাই সেটা নিতে ব্যর্থ হই।
নূর হোসেন চেয়েছিলেন, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’ আমি মনে করি যে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা সামরিক জান্তাকে পরাস্ত করতে পেরেছিলাম, কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব রয়ে গেছে। এটা দূর করতে হবে।
ছাত্রসমাজের দশ দফা, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্যজোটের পাঁচ দফা দাবি ও ১৭টি কৃষক সংগঠন একত্র হয়েছে। ছোট-বড় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরছে। দেখা গেল সব ছাপিয়ে সুকৌশলে উঠে এল একটা দাবি, ‘এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি’।
এটাই ছিল আন্দোলনের একটা বড় ভুল। আমরা কি শুধু এক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাম? আমরা আন্দোলন করেছি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। জনগণের রায় না নিয়ে আর কেউ যাতে ক্ষমতার দিকে হাত না বাড়ায়। কিন্তু সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। যেহেতু ক্ষমতার কাঠামো থেকে স্বৈরতন্ত্রকে দূর করতে পারিনি, ফলে সেই পতিত স্বৈরাচার এখন আবার পুনর্বাসিত।
নূর হোসেনের যে চেতনা ছিল—স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক—এটাই আসলে আমাদের নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা। আমি মনে করি, সেই চেতনার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।
বজলুর রশিদ ফিরোজ: নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন নিয়ে এক কথায় বললে, কিছু পেয়েছি, আর কিছু পাইনি। এরশাদের সামরিক শাসনের ফলে বিভিন্নভাবে বাধা আসতে থাকে। যেমন: শিক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে বাধা, পোস্টার লাগাতে গিয়ে শিবলী কাইয়ুম গ্রেপ্তার হওয়া, জাসদ ছাত্রলীগের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ, ছাত্র-শিক্ষকের ওপর হামলা ইত্যাদি। এভােবই আন্দোলনের সূত্রপাত হতে থাকে।
পরবর্তী সময়ে সব সংগঠন মিলে ছাত্র ঐক্য পরিষদ গড়ে তোলা হয়। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সদস্য। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের শেষ দিকে ১৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার হই। ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার পতনের িদনই মুক্তি পাই।
গণ-অভ্যুত্থানের বিজয় এক অর্থে হারিয়ে যায়। অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হয়ে যদি আন্দোলনকারী শক্তির দ্বারা সরকার গঠিত হতো, তারাই তাদের দাবিগুলো মেটানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারত এবং পরবর্তী সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারত। এমনি করে একাত্তরের পরও যদি দলীয় সরকার না হয়ে একটি জাতীয় সরকার হতো, তাহলে হয়তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে পারত। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে প্রতিনিয়ত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত হয়েছে।
আজও মনে আছে, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের অফিসে তিন জোটের একটা সমঝোতা বৈঠক হয়। সেই বৈঠকের প্রস্তাব ছিল আন্দোলনকারী শক্তির সরকার প্রতিষ্ঠার। সেখানে আন্দোলনকারী ৮ দল, ৭ দল, ৫ দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আন্দোলনকারী দলগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন মতপার্থক্যের জন্য সেটা হয়নি।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়েছি মাত্র। কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক যে বিধিবিধান, আইনকানুন সেগুলোর এখনো পরিবর্তন করতে পারিনি। এই নয় বছরের মধ্য দিয়ে যাওয়া অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের যে ধরনের পরিবর্তন হওয়ার দরকার ছিল তা হয়নি।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন: নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন নিজস্ব শক্তি ও স্বাধীনতা নিয়ে দঁাড়াতে পারেনি। অন্যদিকে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা গ্রহণের প্রতি যতটা প্রত্যাশা ছিল, গণতন্ত্রের প্রতি তেমন প্রত্যাশা লক্ষ করা যায়নি।
ক্ষমতায় এসে অনেককেই দেখা যায়, কলমের খোঁচায় কয়েক শ গুণ ধনসম্পদের মালিক হন। কিন্তু তঁাদের অনুসারীদের স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার সুযোগ থাকে না, ফলে তাঁরা বেছে নেন সন্ত্রাসের পথ।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা যদি বলি, সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, এখন তো অনেক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, তাই রেডিও-টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি অবান্তর। তার মানে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যে রেডিও-টেলিভিশন চলবে, সেটা ক্ষমতাসীন সরকারের যে একতরফা প্রচার, সেটাই করবে! এরশাদের সময় আমরা একে ডাকতাম ‘সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স’। এখনো কি সরকারি রেডিও-টেলিভিশন চ্যানেল সেই ‘সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স’ই থেকে যাবে?
গত ২৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংসদ বর্জনে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, যা কখনো গণতান্ত্রিক কাঠামোর অংশ হতে পারে না।
এরশাদের সময় নূর হোসেনকে গুলি করে মারা হলো, মৌলিক অধিকারের কোনো সুরক্ষা ছিল না, আইনের শাসন ছিল না। বিএনপির আমলে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’-এর নামে জ্যান্ত মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। আর এখন চলছে ক্রসফায়ার–এনকাউন্টারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম।
মানে কী দাঁড়াল? এরশাদের সময় মানুষকে গুলি করে মারা হতো। আর পরবর্তীকালের শাসকগোষ্ঠী, যাঁরা নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এলেন তাঁদের শাসনব্যবস্থার মধ্যেও কিন্তু ওই একই ধরনের আইনের শাসন লঙ্ঘিত হলো। মানুষের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়নি।
মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল: নব্বইয়ের ১০ অক্টোবর জিহাদ শহীদ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে জিহাদের মৃত্যু ছাত্রসংগঠনগুলোকে ভীষণভাবে অহত করে। এই প্রথম ২২টি ছাত্রসংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে তোলা হয়। এই ছাত্র ঐক্যের মাধ্যমেই নয় বছর ধরে টানা আন্দোলন চলে। এবং বিজয় অর্জিত হয়।
স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর, ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ও তিন জোটের সম্মতিক্রমে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। আর সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন ছিল গণতন্ত্র, আবার নব্বইয়ের স্বৈরাচারী শাসকের পতনের মূল চেতনাও গণতন্ত্র। আমাদের সবার দুর্ভাগ্য, সেই গণতন্ত্র এখন নির্বাসিত।
বর্তমানে চলছে একে অপরকে দোষারোপের রাজনীতি। ভোটাধিকার এই দাবিদাওয়ার অবস্থান থেকেই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করতে পেরেছিলাম। এবং সে কারণে আমরা জয়ী হয়েছিলাম। অথচ আজকে চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের বড় অর্জন ‘গণতন্ত্র’ ধ্বংসের পথে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানেও গণতান্ত্রিক চেতনা নেই। এখন মূল বিষয় হেলা, দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা, সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন ও সরকার গঠন।
৮২ থেকে ৯০-এর সময়টায় সংকীর্ণতা দূরে ঠেলে জাতীয় স্বার্থকে বড় করে দেখতে পেরেছিলাম। এখন দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারছি না। এমনকি জাতীয় পর্যায় বলেন, ছাত্রসমাজ বলেন, সুশীল সমাজ বলেন, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক বলেন, আমরা কেউই দেশের প্রতি দায়িত্ব অনুভব করছি না। তাই আমি বলব, আজকের বাংলাদেশকে বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে আনতে আমাদের জাতীয় মতৈক্য দরকার, জাতীয় জাগরণ দরকার।
জহিরউদ্দিন স্বপন: আজকের আলোচনার মূল বিষয় নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে কী চেয়েছি, কী পেয়েছি। আমাদের ১০টি দাবি ছিল। তাই অন্তত ১০টি বিষয় তো চেয়েছিলাম।
আমাদের আন্দোলনটি মূলত হয়েছে ‘সামরিক শাসনবিরোধী’। এর মানে হলো সামরিক শাসন ছাড়া স্বৈরশাসনে আপত্তি নেই। এখন যদি কোনো বেসামরিক স্বৈরশাসনের সঙ্গেও পরিচিতি লাভ করি, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
১৯৮৬ সালে এরশাদ শাসনামলের সংসদ আর আজকের সংসদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। ১৯৮৬ সালের নির্বাচন ও সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন একই রকম। নব্বইয়ের আন্দোলনের মূল চেতনা ছিল জনগণের ক্ষমতায়ন। সেটা সম্পূর্ণ হারিয়েছি।
এখন আমরা স্বৈরশাসনে আছি নাকি নির্বাচিত সরকারের অধীনে আছি? প্রশ্নের উত্তর আপনারা দেবেন। বিশ্বাস করি এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যেসব মানুষ যুক্ত ছিলেন তঁারা কখনো না কখনো আবার জেগে উঠবেন।
সময়ের সেঙ্গ আমাদের অনেক ধরনের মত ও পথের পরিবর্তন হয়েছে। ফলে অনেকেই আগের মতো সরব হতে পারছি না। আবার বিশ্বাস করি, এখনো আওয়ামী লীগ, বিএনপির মধ্যে অনেক ভালো মানুষ আছেন। বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। তঁারাই পরিবর্তন আনতে পারবেন।
অামরা স্বাধীনতার যুদ্ধ করেছি। বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সংকটের মধ্যে আমরা কাজ করেছি। অনেক সংকটের সমাধান করেছি। এখন আমাদের সবার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত একটা প্রাতিষ্ঠানিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা কারা।
প্রাতিষ্ঠানিক সরকার লুটপাট–দুর্নীতি করবে, না কী করবে সেটা পরের ব্যাপার। শেষ কথা হলো নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল জনগণের ক্ষমতায়ন। সেটা সম্পূর্ণ হারিয়েছি। জনগণের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে আবার সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
অসীম কুমার উকিল: নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানে আমরা সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করলাম। ৮ দল, ৭ দল, ৫ দল ও বাম বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে কাজ করব। আন্দোলনে আমাদের অনেক বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে গর্ব করে বলতে পরি, রাজনীতির এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের আমরা সংগঠক, কর্মী, সমর্থক।
আমরা যা চেয়েছি তার কিছু পেয়েছি, কিছু পাইনি। যা পেয়েছি সেই অর্জনগুলো সঙ্গে নিয়ে সামনে এগোব। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর যদি সবাই একত্রে থাকতে পারতাম, এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাজ করতে পারতাম, তাহলে অর্জনের তালিকা আরও অনেক লম্বা হতে পারত।
গণ–অভ্যুত্থানের বড় সাফল্য হেলা, রাতের অাঁধারে ক্ষমতা দখলের চিন্তা এখন সম্ভবত নেই। ভবিষ্যতেও এটা বাংলাদেশে আর হবে না। সে সময়ে শিক্ষানীতির যে দাবি ছিল সেটা পেয়েছি। বাক–ব্যক্তি, বিশেষ করে গণমাধ্যমের ব্যাপক স্বাধীনতা পেয়েছি। নির্বাচন কমিশন নিয়ে অনেক কথা আছে। আমাদের অাজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন ছিল। এখনকার নির্বাচন কমিশন নারীেদর চুড়ি প্রতীক দিচ্ছে। এটা নিয়ে নারীরা প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু আমরা কেউ কথা বলিনি। নির্বাচন কমিশনের উচিত সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা। আমাদেরও কমিশনকে সহযোগিতা করতে হবে।
এখন ছাত্র ভর্তি, টেন্ডার–পদ্ধতি অনলাইনে চলে গেছে। এখানে ছাত্র–বাণিজ্য নেই। বাসে চড়ে ঢাকায় এসে সাংসদ হচ্ছেন। কয়েক দিনের মধ্যেই পাঁচ কোটি টাকার গাড়িতে চড়ছেন। তাহলে ছাত্রনেতারা কি সারা জীবন মধুর ক্যানটিনে খাবে? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
আপনারা ছাত্রনেতা নিয়ে কথা বলছেন। গাড়িওয়ালাকে কেন ধরছেন না? কীভাবে একজন সাংসদের গাড়ি–বাড়ি–টাকা হয়, কীভাবে বিদেশে গাড়ি–বাড়ি হয়, কীভাবে দেশের টাকা বিদেশে যায়? এ জায়গায় হাত দিন।
আমাদের নেতাদের এত রোগ হয় প্রতিনিয়ত সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, নিদেনপক্ষে দেশের নামকরা হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। অামার ভাই একটা নামকরা হাসপাতালে ২১ দিন ছিল। অসহ্য হয়ে তাকে সেখান থেকে বের করে অন্য একটি হাসপাতালে এনেছি। পয়সা কত দিয়েছি বলব না। আমি তঁাদের জিজ্ঞেস করেছি আপনারা কী করেন, এখানে কী হচ্ছে। তঁারা বলেছেন, দেশের মানুষের অনেক টাকা, তঁাদের খরচ করার জায়গা নেই। তঁারা এখানে আসেন।
জঙ্গিবাদসহ অনেক সমস্যার মূলে একাত্তরের ঘাতক, দালাল, রাজাকার। দেশ যখন সামনের দিকে এগিেয় যায়, মানুষ যখন শান্তিতে বসবাস করে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে, তখনই জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এদের নির্মূল করতে না পারলে দেশ বারবার পেছনে চলে যাবে।
এখন আমরা সেই সময়ের আন্দোলনের বন্ধুরা একসঙ্গে বসতেও পারি না। বসলেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজা হয়। তবে সবশেষে বলব, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থী, ডানপন্থী, গণমাধ্যম—সবার দায়িত্ব আছে। সবাই মিলে দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করলে একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে পারব।
আব্দুল কইয়ুম: আমরা ফিরে দেখতে চেয়েছিলাম গণ–অভ্যুত্থানের ২৫ বছর পর কী পেয়েছি কী পাইনি। অনেকেই বলেছেন, কিছু পেয়েছি কিছু পাইনি।
নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের পর আমরা গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরেছি। যদিও গণতন্ত্র িনয়ে মানুষের মধ্যে কিছু প্রশ্ন থেকে গেছে। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে সবকিছু অর্জিত হবে বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
যাঁরা অংশ নিলেন
অসীম কুমার উকিল : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
নাজমুল হক প্রধান : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), সাংসদ, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
শামসুজ্জামান দুদু : সাবেক সভাপতি, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
আবদুল্লাহ আল কাফি : সাবেক সহকারী সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
জহিরউদ্দিন স্বপন : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী
বজলুর রশিদ ফিরোজ : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট
মোশরেফা মিশু : সাবেক সভাপতি, ছাত্র ঐক্য ফোরাম
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো