এলাকায় যখনই কোনো শিশুর জন্মের খবর পান, তখনই গাছের চারা হাতে নবজাতকের বাড়িতে ছুটে যান তিনি। নিজের হাতে বাড়ির আঙিনায় চারাটি রোপণ করেন। নবজাতকের মা-বাবাকে চারা গাছটির নিয়মিত যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দেন। নবজাতকের জন্য বৃক্ষ—ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ নিয়ে তিন বছরে ৯০৫ নবজাতকের বাড়িতে গাছ লাগিয়েছেন গোপাল চন্দ্র বর্মণ। এর বেশির ভাগই ফলদ বৃক্ষ।
গোপাল চন্দ্র বর্মণ পেশায় শিক্ষক। বয়স ৩২ বছর। গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলায় তাঁর বাড়ি। শিশু জন্মের সঙ্গে গাছ লাগানোর সম্পর্ক কী—জানতে চাইলে গোপাল চন্দ্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনটি কারণে এই উদ্যোগ নিয়েছি। এক. শিশুর বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন দরকার। গাছ অক্সিজেন দেয়। কিন্তু জনসংখ্যা অনুপাতে গাছের সংখ্যা খুবই কম। শিশু বড় হলে তার অক্সিজেনের চাহিদা বাড়বে, গাছও বাড়তে থাকবে আর অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াবে। দুই. পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে এবং তিন. শিশুর সঙ্গে সঙ্গে গাছটি বড় হয়ে ভবিষ্যতে আর্থিক সহায়তা দেবে শিশুর পরিবারকে।
গাইবান্ধা সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক জীবন কুমার সাহা বলেন, নবজাতকের জন্য গোপাল চন্দ্রের গাছ উপহার দেওয়া নিঃসন্দেহে
ভালো উদ্যোগ। গাছ অক্সিজেন, ছায়া, খাদ্যসহ অনেক কিছু দেয়।
গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে সাঘাটা উপজেলার ঘুড়িদহ ইউনিয়নের মথরপাড়া গ্রাম। এখানেই গোপাল চন্দ্র বর্মণের বসবাস। তিনি ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৯০৫টি শিশুর বাড়িতে গাছের চারা লাগিয়েছেন। এর মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কমলা, মাল্টা, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া অন্যতম। নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বটতলা আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ৩৮০ জন ছাত্রছাত্রীকে বিনা মূল্যে গাছ সরবরাহ করেছেন তিনি। প্রতিবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নানা অনুষ্ঠানে তিনি বিনা মূল্যে গাছ বিতরণ করেন।
কয়েক বছর আগে গোপাল চন্দ্র নিজ উদ্যোগে স্থানীয় একটি ক্লাবে পত্রিকা কিনে দিতেন। মাসে তাঁর ২০০ টাকার মতো খরচ হতো। একসময় পত্রিকা সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। পরে গোপাল চন্দ্র এই টাকা কাকে দেবেন, ভাবতে থাকেন। একবার ভাবেন, গরিব মানুষকে শাড়ি, লুঙ্গি দেবেন। কিন্তু একজনকে দিলে আরেকজন মন খারাপ করবেন। পরে সিদ্ধান্ত নেন, গাছ বিতরণ করবেন। কিন্তু কাকে গাছ দেবেন? ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। ওই সময় তাঁর ভাবনায় আসে, যখন একটি শিশু জন্মায়, তখন প্রকৃতি থেকে সে অক্সিজেন নেয়। অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। আর গাছই দিয়ে থাকে সেই অক্সিজেন। তাহলে নবজাতকের বাড়িতে গাছ লাগানো যায়। এতে কেউ মন খারাপ করবে না।
২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন সাঘাটার ঘুড়িদহ ইউনিয়নের উত্তর মথরপাড়া গ্রামের গৃহবধূ শিউলি বেগম। লোকমুখে খবর পান গোপাল চন্দ্র। তিনি একটি আমগাছের কলম নিয়ে ওই বাড়িতে হাজির হন। বাড়ির লোকজন উদ্দেশ্য জেনে তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। বাড়ির উঠানের পাশে গর্ত খুঁড়ে গোবর সার দিয়ে গাছ রোপণ করেন গোপাল। শিশুটির বাবা আবদুর রাজ্জাক ব্যাপারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোপালদা আমার ছেলে শিফাতের জন্মের খবর শুনে একটি আমগাছ লাগিয়ে দিয়ে গেছেন। ছেলের বয়স এখন ৩ বছর ১০ মাস, গাছের বয়সও তা–ই। গত মৌসুমে আমও ধরেছিল গাছটিতে। খুব খুশি লেগেছে ফল দেখে।’
ওই বছরের ২৮ মে জন্ম নেয় সাঘাটার কচুয়া ইউনিয়নের পাচিয়ারপুর গ্রামের রুনাইয়া আহম্মেদ। শাহিনা বেগম নামের এক স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে খবর পান গোপাল। এবারও একটি আমের চারা নিয়ে নবজাতকের বাড়িতে হাজির তিনি। রুনাইয়া আহম্মেদের বাবা স্কুলশিক্ষক শামসুজোহা মিয়া বলেন, ‘আমি তাঁর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কারণ, মানুষের সঙ্গে গাছের সম্পর্ক আছে। গাছটি বড় হলে ফল পাওয়া যাবে, পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে।’
একই ইউনিয়নের উল্লাসোনাতলা গ্রামে ২০১৬ সালের জুন মাসে জন্ম নেয় মুগ্ধ বাবু। এক স্কুলছাত্রের কাছে ওই শিশুটির জন্মের খবর পেয়ে বাইসাইকেলে করে একটি লিচুগাছের চারা নিয়ে চলে যান নবজাতকের বাড়িতে। শিশুটির বাবা কৃষক মানিক মিয়া বললেন, ‘গাছটি বড় হয়েছে। ছেলের মতো গাছটিরও যত্ন করছি। আশা করছি অল্প দিনের মধ্যে ফল পাব।’
চলতি বছরের ১৪ আগস্ট জন্ম নেয় ঘুড়িদহ ইউনিয়নের বাউলিয়া গ্রামে সাবিদ সরকার। স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে খবর পেয়ে একটি কমলাগাছ নিয়ে ছুটে যান গোপাল। শিশুটির মা ফাতেমা বেগম বললেন, ‘আমার স্বামী ঢাকায় সিএনজি চালায়। দুই ছেলে আমার। সন্তানের জন্য গাছ লাগানোর কথা কখনো ভাবিনি। গোপালদা ছেলের জন্মের কথা শুনে গাছ দিয়েছেন। খুব ভালো লাগল। ফল বিক্রি করে ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারব।’
নিজের স্কুলের ছাত্রছাত্রী, ব্র্যাকের স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী, কমিউনিটি ক্লিনিকের নার্সদের কাছ থেকে শিশু জন্মের খবর পান গোপাল চন্দ্র। এর মধ্যে অন্যতম সংবাদদাতা সাঘাটা ব্র্যাক স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্যকর্মী শাহিনা বেগম। শাহিনা বললেন, ‘আমি সাঘাটার ঘুড়িদহ, কচুয়া ও কামালেরপাড়া ইউনিয়নে গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবার কাজ করি। এই তিনটি ইউনিয়নে প্রতি মাসে গড়ে সাত-আটটি শিশু জন্ম নেয়। গোটা উপজেলায় আমার মতো স্বাস্থ্যকর্মী আছেন ১০ জন। গোপালদার উদ্যোগটি অসাধারণ। তাই আমরাই সব স্বাস্থ্যকর্মী সন্তান জন্মের খবর পেলে দ্রুত দাদাকে জানাই।’
গোপাল চন্দ্র বর্মণের জন্ম সাঘাটার কচুয়া ইউনিয়নের উল্লাসোনাতলা গ্রামে। বাবা কৃষক কমল চন্দ্র বর্মণ। বর্তমানে ঘুড়িদহ ইউনিয়নের মথরপাড়া গ্রামে বসবাস করেন গোপাল। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে গোপাল সবার ছোট। বড় ভাই কালিপদ চন্দ্র বর্মণ ব্যবসা করেন। একমাত্র বোন কৃষ্ণা রানীর বিয়ে হয়েছে। গোপাল চন্দ্র ২০১৪ সালে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী সাথী রানী বটতলা আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সহকারী শিক্ষক। একমাত্র মেয়ে অন্বেষা রানীর বয়স আড়াই বছর। মেয়ের জন্মের পর তিনি নিজ বাড়িতেও মাল্টাগাছ লাগিয়েছেন।
গোপাল চন্দ্র ২০০১ সালে বোনারপাড়া কাজী আজাহার উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। অভাব-অনটনের কারণে কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। পরে তিনি বগুড়ার কাহালু উপজেলায় কৃষিশ্রমিকের কাজ নেন। এরপর সাতরং নামের বগুড়ার একটি আর্ট স্কুলে চাকরি নেন। সেই উপার্জন দিয়ে তিনি ২০১৩ সালে বগুড়া আর্ট কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে গত এপ্রিলে বিএফএ পরীক্ষা দিয়েছেন। এখনো ফলাফল বের হয়নি।
এর মধ্যেই ২০০৮ সালে গোপাল চন্দ্র বটতলা আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুল নামে নিজের গ্রামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। স্কুলটিতে প্লে থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ৩৮০ জন ছাত্রছাত্রী আছে। শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ১৭। গোপাল চন্দ্র স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।
সাঘাটার ঘুড়িদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজাদ মিয়া, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুবিনুজ্জামান চৌধুরী, উপজেলা কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যসচিব আজিজুর রহমান ভূয়সী প্রশংসা করেন গোপাল চন্দ্রের। স্ত্রী সাথী রানীও স্বামী গোপাল চন্দ্রের অনন্য উদ্যোগে পাশে আছেন। ‘তাঁকে গাছ লাগানোর কাজে সব সময় উৎসাহ দিই। আর বাড়ির কাজ আমি নিজেই সামলে নিই’—বললেন সাথী রানী। গোপাল চন্দ্র ভবিষ্যতে গোটা জেলায় তাঁর এই কাজ ছড়িয়ে দিতে চান। এর জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তিনি।