নদীর চরে রাকিবুলের মাছ চাষ

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় গড়াই নদের চরে তিন বছর ধরে মাছ চাষ করছেন সাগর (বাঁয়ে)। বালু সরিয়ে পলিথিন বিছিয়ে কৃত্রিম পুকুর তৈরি করে পাঁচ মাস চলে এই চাষ। তারপর চরটি চলে যায় পানির নিচে। প্রথম আলো
ঝিনাইদহের শৈলকুপায় গড়াই নদের চরে তিন বছর ধরে মাছ চাষ করছেন সাগর (বাঁয়ে)। বালু সরিয়ে পলিথিন বিছিয়ে কৃত্রিম পুকুর তৈরি করে পাঁচ মাস চলে এই চাষ। তারপর চরটি চলে যায় পানির নিচে।  প্রথম আলো

শুষ্ক মৌসুম শুরু হলেই আস্তে আস্তে চরের পানি নামতে থাকে। মুখ বের করে চিকচিক হাসে সাদা বালু। আর হাসেন রাকিবুল ইসলাম। তিনি প্রস্তুত হন মাছ চাষের সরঞ্জাম নিয়ে। কিন্তু পরিত্যক্ত বালুচরে কীভাবে মাছ চাষ হবে?

হ্যাঁ, হয়। রাকিবুল সে পথ দেখিয়েছেন। পানি নেমে গেলে চরের নরম মাটি তিন ফুটের মতো খুঁড়ে তাতে পলিথিন বিছিয়ে ঘের তৈরি করেন তিনি। তারপর শ্যালো মেশিন দিয়ে নদী থেকে পানি তুলে ভরা হয় তা। তাতে কিছু কচুরিপানা দিয়ে ছায়াও তৈরি করা হয়। ছাড়া হয় মাছের পোনা। এই হলো বালুচরে মাছ চাষের কায়দা।

ঝিনাইদহের শৈলকুপার সীমান্তবর্তী গড়াই নদের চরে রাকিবুলের এই মাছ চাষ মৎস্য কর্মকর্তাদেরও নজর কেড়েছে। তাঁরা বলছেন, এমন অব্যবহৃত জায়গায় স্বল্পমেয়াদি মাছ চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশে পুষ্টির জোগান বাড়ানো সম্ভব।

ওই চরে রাকিবুল এবারও তৈরি করেছেন চারটি ঘের। তাতে ছেড়েছেন তেলাপিয়া, জাপানি পুঁটি আর গলদা চিংড়ির পোনা। ছিটানো খাবার খেতে মাছগুলোর প্রতিযোগিতা দেখলেই মন ভরে যায়।

শৈলকুপা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি রাকিবুলের মাছ চাষ দেখে এসেছেন। চাষ পদ্ধতি ঠিক আছে। সাধারণত ২৮ থেকে ৩১ ডিগ্রি তাপমাত্রায় মাছ চাষ করা হয়। রাকিবুল যেভাবে পলিথিন বিছিয়ে দেন, তাতে পানি অনেকটা ঠান্ডা থাকে। আর পানির ওপর কিছুটা কচুরিপানাও দিয়ে দেন। এতে তাপমাত্রা মাছ চাষ উপযোগী থাকে।

রাকিবুলের বয়স পঞ্চাশের মতো। শৈলকুপা উপজেলার বাখরবা গ্রামের জানিক বিশ্বাসের ছেলে তিনি। তাঁরা চার ভাই ও দুই বোন। রাকিবুল সবার বড়। আর্থিক সচ্ছলতার পেছনে ছুটতে ছুটতে সংসার করা হয়ে ওঠেনি তাঁর। অন্য ভাইয়েরা পৃথক সংসার করেন, আর তিনি থাকেন বাবা-মাকে নিয়ে।

রাকিবুল কুষ্টিয়া জেলার ডাঁসা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর কুষ্টিয়ার খোকশা কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু পারিবারিক সমস্যার কারণে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি। পড়ালেখা বন্ধ রেখে কৃষিকাজ শুরু করেন। ১৯৯১ সালে আবার সেই খোকশা কলেজে গিয়ে ভর্তি হন। অনিয়মিতভাবে পড়ে ১৯৯৯ সালে তিনি বিএসএস পাস করেন। রাকিবুল জানান, পড়ালেখা করলেও চাকরি পাননি। পরিবারের সম্বল তিন বিঘা জমিতে চাষবাস চালিয়ে যান। কৃষির আয় থেকে বাবা-মা ও তাঁর সংসার চলে।

কৃষিকাজের পাশাপাশি রাকিবুল গ্রামের মানুষের ছোট ছোট সাতটি পুকুর লিজ নিয়ে সেখানে মাছের চাষ করতেন। কিন্তু তেমন লাভ হতো না। এর মধ্যে একবার থাই কই মাছে মড়ক লেগে সর্বস্বান্ত হন। আবার কৃষি তাঁর একমাত্র অবলম্বন হয়ে পড়ে।

রাকিবুল প্রথম আলোকে জানান, সরকারের একটি আহ্বান তাঁর মনে লেগেছে। তিনি শুনেছেন একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পরিত্যক্ত জায়গা কাজে লাগাতে হবে। তখনই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গড়াই নদের চরের কথা মনে হয় রাকিবুলের।

কিন্তু কী করবেন চরের পরিত্যক্ত জায়গায়? এমন কিছু করতে হবে যেন চরটি ডুবে যাওয়ার আগেই চাষ শেষ করা যায়। আবার নদীরও কোনো ক্ষতি না হয়। রাকিবুল জানেন কৃষিকাজ, আর মাছ চাষ। বালুচরে তো কোনো কৃষি হবে না। বাকি থাকে মাছ চাষ। তা-ই সই। নিজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে নেমে পড়েন কাজে।

রাকিবুল জানান, তিন বছর আগে মা জবেদা খাতুনের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। সঙ্গে ধারদেনাও করেন। প্রথমবার তিনটি ঘের করেছিলেন। এরপর প্রতিবছর চারটি করে ঘের তৈরি করেন। রাকিবুল জানান, অক্টোবর মাস এসে গেলেই চর জাগতে শুরু করে। মে মাস পর্যন্ত এই চর থাকে। নভেম্বর মাসের প্রথম দিকেই ঘের তৈরি করা যায়। ডিসেম্বরে মাছ ছাড়া হয়। এবারও তিনি ডিসেম্বর মাসের ২৯ তারিখে মাছের পোনা ছেড়েছেন। ১০৫ ফুট দৈর্ঘ্য, ১৮ ফুট প্রস্থ আর ৩ ফুট গভীর চারটি বেড তৈরি করতে তাঁর খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। মাছের পোনা ছাড়া, খাবার দেওয়া থেকে পরিচর্যা পর্যন্ত খরচ হবে আরও ২০ হাজার টাকা। মাছ বিক্রি করে পাবেন ৯০ হাজার টাকার মতো। মে মাসেই মাছ বিক্রি শেষ হবে। এরপর পানিতে ডুবে যাবে চর।

এই মাছ চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে রাকিবুল জানান, বালুর ওপর মাছ চাষের কথা মাথায় আসার পর তিনি তা নিয়ে কিছু পড়ালেখা করেন। সঙ্গে গবেষণাও। স্থানীয় কাতলাগাড়ি পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কোনায় তিনি বালুর ওপর পানি আটকে পরীক্ষামূলকভাবে মাছ চাষ করেন। ভালো ফল সম্ভব—এমনটা নিশ্চিত হওয়ার পর নদীর চরে শুরু করেন মাছ চাষ।

রাকিবুল জানান, রোদ ও গরম থেকে মাছকে রক্ষা করতে কৃত্রিম এই পুকুরের এক কোণে কচুরিপানা দিয়ে রাখেন। মাছকে নিয়মিত খাবার দেন। ৫০ হাজার টাকার মতো পুঁজি খাটিয়ে পাঁচ মাসে তিনি ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করেন।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (স্বাদু পানি উপকেন্দ্র, চাঁচড়া, যশোর) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, কম সময়ে মানে তিন থেকে চার মাসে বিক্রি উপযোগী হয় এমন মাছের মধ্যে আছে তেলাপিয়া, কই, সরপুঁটি, ট্যাংরা ইত্যাদি। তবে চরের কৃত্রিম পুকুরে তেলাপিয়ার উৎপাদন ভালো হলেও তাপমাত্রা বেশি হলে চিংড়ি এবং পুঁটির উৎপাদন কমে যেতে পারে। কচুরিপানা, তালপাতা বা অন্য কৃত্রিম আশ্রয় তৈরি করে দিলে পুঁটির উৎপাদন বাড়বে। কিন্তু গলদা চিংড়ির যথাযথ উৎপাদন পেতে কমপ‌ক্ষেÿছয় মাস পুকুরে রাখতে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এইচ এম কোহিনুর প্রথম আলোকে বলেন, নদীর চরে অস্থায়ী ঘের বানিয়ে মাছ চাষের এই পদ্ধতি দেশে এই প্রথম। ওই চাষির এই সফলতা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।