নতুন সড়ক পরিবহন আইনের পুরোপুরি প্রয়োগ কবে থেকে শুরু হবে, সে বিষয়ে পরিষ্কার নয় সরকারের কোনো সংস্থা। এরই মধ্যে পরিবহনমালিকদের সংগঠনগুলো আইনের প্রয়োগ এক থেকে দুই মাস পিছিয়ে দিতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে আবেদন করেছে।
সংসদে পাস হওয়ার এক বছরের বেশি সময় পর ১ নভেম্বর থেকে নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হয়েছে। তবে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আইনের প্রয়োগ প্রথমে এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এরপর সময়সীমা আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়। গত বৃহস্পতিবার মৌখিক সেই ঘোষণার সময়সীমা শেষ হয়েছে।
সড়ক পরিবহন আইন প্রয়োগে মূল দায়িত্ব পুলিশ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। পুলিশ সূত্র জানায়, তারা মনে করছে, নতুন আইনের নানা ধারা অমান্যের দায়ে যে জরিমানার বিধান রয়েছে, তা বেশ কঠোর। পরিবহনমালিক, শ্রমিক ও জনগণের মধ্যে এখনো পুরোপুরি সচেতনতা আসেনি। তারা সংশ্লিষ্টদের (স্টেকহোল্ডার) নিয়ে একটা বৈঠক করবেন। এ ছাড়া যে যন্ত্রের মাধ্যমে (পজ মেশিন) পুলিশ মামলা করে থাকে, সেটির সফটওয়্যার এখনো হালনাগাদ করা সম্পন্ন হয়নি। তাই কাগজের স্লিপের মাধ্যমে মামলা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে নতুন আইনের প্রয়োগ শুরু হতে আরও সপ্তাহখানেক লেগে যেতে পারে।
এই বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, আইনটি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কাজ চলছে। আজ রোববার আইনের প্রয়োগ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তাঁরা কথাবার্তা বলবেন। এরপরই আইনের প্রয়োগ শুরু হবে। তবে তিনি আইনটি প্রয়োগের সুনির্দিষ্ট তারিখের কথা বলেননি।
বিআরটিএ সূত্র বলছে, আইনের বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। তবে এটি গেজেট আকারে প্রকাশ করতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে। এখন যানবাহনের নিবন্ধন, ফিটনেস সনদ প্রদান, চালকের লাইসেন্স দেওয়াসহ দৈনন্দিন নানা কাজ আগের বিধিমালা মেনে করা হচ্ছে। সংস্থাটি ঢাকাসহ সারা দেশে ১১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকে। নতুন আইন কার্যকর হওয়ার পর ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম বন্ধ আছে। কারণ, নতুন আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তফসিলভুক্ত করার নিয়ম রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই আনুষ্ঠানিকতা শেষ পর্যায়ে। আজ রোববার এ–সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশের আশা করছে বিআরটিএ। এরপরই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তফসিলভুক্ত হওয়ার গেজেট হলেই তাঁরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু করবেন। আইনের বিধিমালাও শিগগিরই হয়ে যাবে বলে তিনি জানান। তবে কবে থেকে আইনের প্রয়োগ শুরু, সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করেননি।
এদিকে গত সোমবার পরিবহনমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি গত সোমবার চিঠি দিয়ে এক মাস পর নতুন আইন কার্যকর করার অনুরোধ জানিয়েছে। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সচিবকে এ–সংক্রান্ত চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে মালিক সমিতি বলেছে, নতুন আইনের প্রয়োগের কথা মাথায় রেখে ফিটনেস সনদ হালনাগাদসহ নানা কাজে পরিবহনমালিকেরা বিআরটিএতে ভিড় করছে। কিন্তু বিআরটিএর লোকবল কম বলে কাজের গতি কম। তাই সময় দিয়ে আইনটি কার্যকর করলে ভালো হয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, আইনের প্রয়োগ এক মাস পিছিয়ে দিতে তাঁরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। তবে মন্ত্রণালয় এখনো তাঁদের কিছু জানায়নি।
সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ও সচিবকে চিঠি দিয়ে দুই মাস সময় চেয়েছে গাবতলী টার্মিনালভিত্তিক মালিক সমিতি বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। তারাও বলেছে, মালিকেরা বিআরটিএতে যেহেতু যাচ্ছেন, তাই সময় দেওয়া উচিত। দীর্ঘদিন ধরে যেসব যানের ফিটনেস সনদ হালনাগাদ নেই, সেসব যানের জরিমানা মওকুফেরও দাবি করেছে তারা।
বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা দুই মাস চেয়েছেন। আশা করছেন সরকার বিবেচনা করবে।
ঢাকার তেজগাঁও ও চট্টগ্রামভিত্তিক ট্রাকমালিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও চিঠি দিয়ে আইন প্রয়োগের সময় বাড়ানোর দাবি করেছে বলে জানা গেছে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মালিকদের দাবি মেনে আনুষ্ঠানিকভাবে হয়তো আইন প্রয়োগের সময়সীমা বৃদ্ধি নাও করা হতে পারে। তবে প্রস্তুতি ও সচেতনতার কথা বলে আইনের প্রয়োগে কিছুটা সময় নেওয়ার পক্ষে মন্ত্রণালয়। এমনকি শুরুতে আইনের বিভিন্ন ধারা ভঙ্গের দায়ে সর্বোচ্চ জরিমানা করা হবে না। পর্যায়ক্রমে জরিমানার পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামকে পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।
এদিকে নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের প্রতিবাদে গতকাল বগুড়ায় বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় স্থানীয় মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন। সকাল থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার পথে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ এই সিদ্ধান্তে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। পরিবহনশ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ২১ ও ২২ নভেম্বর বৈঠক ডেকেছে। ওই বৈঠকে আইন প্রয়োগের বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেবে বলে সংগঠনটির সূত্র জানিয়েছে।