নতুনভাবে আবার শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম
নতুনভাবে আবার শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

নতুন স্বাভাবিকে যেমন বাংলাদেশ চাই

করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মধ্যমেয়াদি থেকে দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যেভাবে একটা অভূতপূর্ব অভিঘাত পড়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি তার থেকে বাইরে নয়। এ অভিঘাত বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিকে আগামী দিনে বেশ প্রভাবিত করবে। প্রশ্ন হচ্ছে কোভিড চলাকালে আমরা যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কথা বলছি, সেটি কেমন হবে এবং কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আমরা আসলে কী ধরনের পরিবর্তনগুলো চাই।

এ কথা ঠিক যে করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেশ বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশ কমে গেছে। যদিও প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে, ওই তর্কে না গেলেও মোটামুটি সবাই স্বীকার করছে যে বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটা ধারা চলে এসেছে, তাতে একটা বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের যে একধরনের সাফল্য দেখা গেছে, করোনাইভাইরাসের সময়ে এই কয়েক মাসেই তাতে একটা বড় ধাক্কা লেগেছে। হঠাৎ করেই একটা বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী, তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে গেছে। নানা হিসাবে মনে করা হচ্ছে এক থেকে দেড় কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হতে পারে এই সময়ে। যারা আগে দরিদ্র ছিল, তারা আরও দরিদ্র হয়েছে। এদের একটা বিশাল বড় অংশ দারিদ্র্যের কবল থেকে সহসা বের না–ও হয়ে আসতে পারে, সেই শঙ্কাটাও রয়েছে। সুতরাং, চলমান সংকটে দারিদ্র্যের ওপরে মধ্যমেয়াদি থেকে দীর্ঘমেয়াদি একটা প্রভাব পড়েছে।

করোনা-উত্তর সময়ে নতুন স্বাভাবিকতায় যে বাংলাদেশকে আমরা দেখতে চাই, সেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আসলে কোন দিকগুলো অগ্রাধিকার দেব? সেই জায়গায় একটা বড় ধরনের প্রশ্ন হচ্ছে এই যে পুনরুদ্ধার, এই পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া এবং পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে অর্থনীতির যে একধরনের বিনির্মাণ, সেই জায়গায় কোন ধরনের অর্থনৈতিক দর্শন কাজ করবে? যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনার পেছনেই একটা অর্থনৈতিক দর্শন থাকে। আমরা গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে একটা খুব বড় ধরনের দিক দেখেছি, যেটাকে আমি বলব ‘প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক দর্শন’। এই প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক দশ৴নের সমস্যা হচ্ছে যে প্রবৃদ্ধির ওপরই উন্নয়ন আলোচনা যদি এতটা নির্ভরশীল হয়, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত সামাজিক উন্নয়নের বৃহত্তর লক্ষ্যমাত্রাগুলোর ক্ষেত্রে একটা ঝাপসা দৃষ্টিভঙ্গি সব সময়ই কাজ করবে।

বড় লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে তিনটি জায়গা খুব গুরুত্বপূর্ণ—দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অসাম্য দূরীকরণ। অবশ্যই দেখতে হবে এই যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্যের হারকে কী পরিমাণ কমাচ্ছে। একটা বিষয় খুব স্পষ্ট হওয়া দরকার, দারিদ্র্য হারের ব্যাপারে প্রচলিত যে সংজ্ঞাগুলো আছে, সেগুলো কিন্তু আসলে খুবই একরৈখিক এবং তাতে শুধু আয়ের পরিমাপ দিয়ে দারিদ্র্যকে মাপা হয়। ফলে দারিদ্র্যের যে একটা বহুমাত্রিক ধরন আছে, সেটা আমরা দারিদ্র্যকে বোঝার ক্ষেত্রে হারিয়ে ফেলি। আমি কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের সে রকম একটা বহুমাত্রিক ধারণাভিত্তিক একটা আলোচনা দেখতে চাই। দেখতে চাই যে দারিদ্র্য বিমোচনের যে পরিকল্পনা এবং যে ধরনের নীতি নির্ধারণ এবং যে উদ্যোগ, সেগুলো সেই বহুমাত্রিক বিষয়গুলোকে ধারণ করবে।

বড় লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে তিনটি জায়গা খুব গুরুত্বপূর্ণ—দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অসাম্য দূরীকরণ। অবশ্যই দেখতে হবে এই যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্যের হারকে কী পরিমাণ কমাচ্ছে।

ইতিহাস কিন্তু বলে সংকটকালই নতুন করে চিন্তা করার সুযোগ সৃষ্টি করে। এই চলমান সংকটের একটা ইতিবাচক দিক হচ্ছে, এটা আমাদের সুযোগ দিচ্ছে সামনের দিনগুলোর উন্নয়ন দর্শন, অর্থনৈতিক দর্শন এবং কর্মপরিকল্পনার ব্যাপারে নতুন করে কিছু চিন্তাভাবনা করার। সেই নতুন চিন্তাভাবনা করার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত আমাদের প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক সংকীর্ণ চিন্তাভাবনা থেকে সরে এসে, একটা বহুমাত্রিক উন্নয়নের যে পরিকল্পনা, সেই দিকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটাকে নিয়ে যাওয়া। অংশীদার, নীতিনির্ধারক এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে যাঁরা সম্পর্কিত আছেন, তাঁদের নিয়ে যদি এ আলোচনাটা এখনই শুরু করা যায় এবং এ ব্যাপারে যদি সঠিক নীতি এবং কর্মপরিকল্পনা স্থির করা যায়, তাহলে কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও সামাজিক বিনির্মাণে আমরা তুলনামূলকভাবে বেশ ভালো পরিস্থিতিতে থাকব।

সেলিম রায়হান

দারিদ্র্যের পাশাপাশি আমাদের একটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। এক দশক ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে হারে বেড়েছে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার তার থেকে অনেক কম। এতে একটা শঙ্কা হয়েছে, দেশে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কি না। একটা বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত, তাদের কর্মপরিবেশে সে রকম কোনো উন্নতি নেই এবং অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমের অধিকারের ক্ষেত্রে তারা নানা ধরনের বঞ্চনার শিকার। সুতরাং, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আসবে। কোভিড চলাকালে আমরা দেখছি যে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে, নিম্নতর কাজে ঢুকেছে, কম মজুরিতে কাজ নিতে বাধ্য হয়েছে এবং এতে জীবিকা নির্বাহের মান কমে গেছে। কোভিডকালে বা কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে আমরা যখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কথা বলছি, এ কথা মাথায় রাখতে হবে যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনাগুলোকে কর্মসংস্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। যে বিশালসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছে, পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে, তাদের কীভাবে কাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা যায় এবং পাশাপাশি বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী যারা শ্রমবাজারে অনানুষ্ঠানিক খাতে আছে তাদের কর্মপরিবেশের এবং শ্রমের অধিকার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, এগুলো নতুন পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে।

আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অসাম্য। আমরা দেখেছি গত এক দশকে যেভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার পাশাপাশি কিন্তু অসাম্যের চিত্রটাও বেড়েছে। অসাম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়। অর্থনৈতিক অসাম্যের পাশাপাশি সামাজিক অসাম্যের বিষয়টাও খুব শক্তিশালী বাংলাদেশে। সামাজিক অসাম্যের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অসাম্য রয়েছে। গত এক দশকে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অসাম্য বেড়েছে, যা প্রশ্ন তুলেছে এই প্রবৃদ্ধি কতটুকু অন্তর্ভুক্তিমূলক? করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতেও কিন্তু এই প্রশ্নটা আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে। অর্থনীতিতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করা গেলে সমাজে অসাম্য বাড়ে। সমাজে যদি দুর্নীতির প্রবল প্রতাপ থাকে, যদি দেখা যায় যে বেশ কিছু বৃহৎ গোষ্ঠী, যারা নানাভাবে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে, তারা অবৈধ সম্পদ বানায়, বিদেশে টাকা পাচার করে, সেটাও কিন্তু অসাম্য সৃষ্টি করে। এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া গেলে অসাম্য সৃষ্টির কারণগুলো দূর করা যাবে না।

অর্থনৈতিক অসাম্যের পাশাপাশি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ভয়াবহ অসাম্য রয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে শহর এবং গ্রামের মধ্যে বৈষম্য, নিম্ন ও উচ্চ আয়ের মানুষের জন্য ভিন্ন স্কুল, ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষার মাধ্যম শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের প্রকট চিত্র তুলে ধরে। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও, অর্থবান মানুষেরা কোনো না-কোনোভাবে দেশ এবং দেশের বাইরে ভালো স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকে। কিন্তু বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী যারা সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর নির্ভরশীল, তারা উন্নত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। কোভিডের সময় তো একটা বড় ধরনের শিক্ষা আমাদের দিল, স্বাস্থ্য খাতের এ রকম একটা বেহাল দশা নিয়ে আসলে করোনাভাইরাসের মতো এ রকম যে সংকট আমরা দেখছি, সেটাকে মোকাবিলা করাটা খুবই কঠিন।

করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে আমরা চাইব বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তিরও বহুমুখীকরণ। বাংলাদেশের অর্থনীতি রপ্তানি খাতের—প্রধানত গার্মেন্টস খাত এবং রেমিট্যান্সের ওপর বেশ নির্ভরশীল। অর্থনীতির ভিত্তির বহুমুখীকরণের জন্য প্রয়োজন অর্থনীতির নীতি, কাঠামো এবং কর্মপরিকল্পনার বড় ধরনের সংস্কার। অর্থনীতির খুব জরুরি কতগুলো জায়গায় সংস্কার অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশের মতো যে দেশগুলো আছে, তাদের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত অনেক কম। এত কম কর-জিডিপির অনুপাত নিয়ে বাংলাদেশের মতো একটা দেশের পক্ষে উন্নয়নের অনেক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। আর্থিক খাতেও বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টরে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এ ধরনের একটা ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে অর্থনীতির ভিত্তিকে বহুমুখীকরণ সম্ভব নয়। কারণ, বিদ্যমান ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় উদীয়মান এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ঋণসুবিধা পাওয়া এবং উন্নতি সম্ভব নয়।

কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে অর্থনীতিকে নতুন পথে গড়ে তোলার একটা সুযোগ আমরা পাচ্ছি। অর্থনীতিকে কীভাবে গড়ে তোলা হবে, সেই ধারণা নেওয়া এবং সেই প্রস্তুতি নেওয়াটাই এই সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড পরিস্থিতি আমাদের গতানুগতিক ধারণা থেকে বের হয়ে আসার একটা দাবি জানায়। কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে, নতুন বাস্তবতায় বাংলাদেশের অর্থনীতির চালকগুলোর ব্যাপারেও নতুন কর্মপরিকল্পনার প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি, যে সংস্কারগুলো কোভিড-পূর্ব পরিস্থিতিতে করা যায়নি, অথচ যেগুলো অতি জরুরি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য, সেই ধরনের সংস্কার এবং কর্মপরিকল্পনাগুলো করা এখন সময়ের দাবি।

সেলিম রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক