৫১ বছর আগের এই দিনের ভোরটা কীভাবে শুরু হয়েছিল, তার বর্ণনা করার মতো শক্তি ধরে এমন কলম খুব কমই আছে। আমার কলমেরও সে শক্তি নেই। আমি যদি সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় থাকতাম—যেমন থেকেছি জীবনের অনেকগুলো বছর—হয়তো আমার বর্ণনায় বাস্তবটা আরেক মাত্রা পেত; যাতে ভয়, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা, কান্না আর হতাশার সঙ্গে যুক্ত হতো অমানবিকতা আর বীভৎসতার অসংখ্য ছবি। কিন্তু সেই ভোরে আমি ঢাকায় ছিলাম না। ছিলাম এক জেলা শহরে, যেখানে ২৫ মার্চ রাতের ঝাপটা এসে পৌঁছাতে কিছুদিন সময় লেগেছে।
২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়-সামরিক শক্তি বাংলাদেশে এক গণহত্যা শুরু করেছিল, যার তুলনা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্ব আর দেখেনি। কিন্তু পশ্চিমের পরাশক্তিগুলো এই গণহত্যাকে আমলেই নিতে চায়নি, বরং যারা এই নির্মমতার চর্চা করেছে একাত্তরজুড়ে, তাদের অস্ত্রে ঘাটতি পড়লে আরও উন্নত অস্ত্রের জোগান দিয়েছে। ২৬ মার্চের ভোরে বাংলাদেশের মানুষ বুঝেছে, যে যুদ্ধটা শুরু হয়ে গেল, তা একান্ত তাদেরই, এই যুদ্ধের ভার তাদেরই নিতে হবে।
সেই ভোরেই ঘর ছেড়ে ঢাকার মানুষ গ্রামের দিকে সরে যাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করল, যা পরে অনেক শহর, এমনকি গ্রামের মানুষকেও করতে হলো। একসময় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সীমানা পেরিয়ে ভারতে যেতে শুরু করল অনেক বিপন্ন মানুষ। গ্রামের কৃষক, শহরের তরুণ, কারখানার শ্রমিক, ছাত্র আর চাকরিজীবীরা ভাবলেন যুদ্ধে যেতে হবে। সামরিক বাহিনীর, পুলিশ এবং বিডিআরের সদস্যরা তৈরি হলেন। যুদ্ধটা যখন শুরু হলো, দেখা গেল, সেটি একটি সত্যিকার জনযুদ্ধে রূপ নিয়েছে।
সেই ভোরে কিছু বাঙালি আবার ভিন্ন প্রস্তুতির কথাও ভাবল। পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে প্রয়োজনে স্বজনদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র তুলে নেওয়ার চিন্তাটা তাদের মনে দানা বাঁধল। এই অল্প কিছু স্বজনঘাতক ছাড়া বাকিদের কাছে ২৬ মার্চ যে বার্তাটা পৌঁছে দিয়েছিল, তা ছিল শোকে মুষড়ে না পড়ে; অনিশ্চিয়তায়, শঙ্কায়, হতাশায় কাতর না হয়ে একটা নতুন শুরুর চেষ্টা করে যাওয়া, যে শুরুটা একসময় আমাদের আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে মুক্তির লড়াইয়ে সবাইকে যুক্ত করবে। শোক ও বিপন্নতাকে সামলে নিয়ে মানুষ সেই লড়াই শুরু করল। ১৭ এপ্রিলের মধ্যে বিশ্ব এক জাতির স্বাধীন প্রকাশ প্রত্যক্ষ করল। যার ঘোষণা ২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়ে রেখেছিলেন।
বাংলাদেশের দীর্ঘ ইতিহাসে গণহত্যার কোনো নজির নেই, জনযুদ্ধেরও কোনো উদাহরণ নেই। যে ঐক্য নিয়ে এ দেশের মানুষ একাত্তরে যুদ্ধ করেছে, তার তুলনীয় কিছু এর ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যাবে না। গ্রামে গ্রামে যখন শহরের মানুষেরা গেল, তাদের জন্য ঘরের দরজা খুলে দিলেন, যাঁদের একটু সামর্থ্য আছে তাঁরা। সৌহার্দ্য, ঐক্য এবং সহমর্মিতার এক অভূতপূর্ব উদাহরণ এই মানুষেরা সৃষ্টি করলেন, যে রকম বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেখালেন কীভাবে একটা জাতি সংগ্রামে-সমরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে।
২.
২০২২ সালের ভোরে এসে আমরা দেখছি, এই ৫১ বছরে আমরা অনেক অর্জনের মাইলফলক পার হয়ে এসেছি, আরও অনেক অর্জনের দিকে আমরা যাচ্ছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও শক্তি, কৃষিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে অনেক সাফল্য। একটা অতিশয় দুর্বল অর্থনীতি নিয়ে আমাদের শুরু হয়েছিল, এখন দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা এই ক্ষেত্রে শুধু ভারতের পেছনে। এ সবই উদ্যাপন করার মতো।
কিন্তু এসব অর্জনের পেছনে আছে যাঁদের পরিশ্রম—সেই কৃষক, শ্রমিক আর সাহসী নারীরা, যাঁরা চার দেয়ালের বাধা ঠেলে পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজে না নামলে বাংলাদেশের পথচলাটা অনেক কঠিন হয়ে যেত—তাঁদের আমরা মনে রাখি না। একাত্তরের যেসব গ্রাম মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছিল, সেসব গ্রামেই এঁদের ঠিকানা। এই পরিশ্রমী মানুষগুলো এখনো একাত্তরের সংকল্পটা ধরে রেখেছেন, অথচ আমরা যারা তাঁদের শ্রমে আখেরটা গুছিয়ে নিই, তারা একাত্তরকেই ভুলে গেছি। অথচ এই মানুষগুলোর কপালেই শুধু নিত্যদিনের জীবনসংগ্রামটা চিরস্থায়ীভাবে লেখা হয়ে গেল। আমরা জানি, একদিকে দারিদ্র্য বাড়ছে, বিপন্নতা বাড়ছে, অথচ অন্যদিকে লাফিয়ে বাড়ছে বিত্তশালীদের সংখ্যা। মহাকোটিপতি উৎপাদনে আমরা বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর একটি। যেদিন স্কুলের ছেলেরা রাস্তায় নেমে রাষ্ট্রের মেরামতি দরকার বলে বড়দের জানিয়ে দিয়েছিল, সেদিন থেকেও যদি আমাদের রাষ্ট্রের নানা প্রতিষ্ঠানের পদ্ধতি আর ব্যবস্থার মেরামতি আমরা শুরু করতে পারতাম, তাহলে আজ ভোরটা অনেক সুন্দর হতো। কিন্তু আমরা শুরুটা করেও শেষ আর করতে পারি না, অথবা পাওয়ার বিষয়টা জানি না।
দারিদ্র্য, বৈষম্য, সহিংসতা, বিপন্নতা—এসবের একটা কোলাজ-ছবি স্বাধীনতার ৫১ বছরে এসে আমরা দেখব, এ কথা ২৬ মার্চের ওই ভোর আমাদের বলেনি। যদি ওই ভোরের কাছে আমরা বিশ্বস্ত হই, তাহলে এই ছবির বিপরীতে এমন এক ছবি আমাদের আঁকতে হবে, যা সারা একাত্তর ধরে আমরা দেখেছি। এই ছবিটি আমরা আঁকতে পারব, তবে তার জন্য প্রয়োজন একাত্তরের সেই সংকল্প, যা ছিল নতুন সৃষ্টির। আর প্রয়োজন সেই ঐক্যের, সেই মানবিকতার, সেই সহমর্মিতার।
ইতিহাস মানুষকে কোনো সুযোগ দেয় না, সুযোগটা মানুষকেই তৈরি করে নিতে হয়। একাত্তরে আমরা তা করেছিলাম।
সুযোগটা আবারও আমরা তৈরি করে নিতে পারি। কিন্তু আমরা কি প্রস্তুত?