রবিউল আলম সংকল্প করেছিলেন বছর চারেক আগে, বিসিএস পরীক্ষায় ভালো করার জন্য। তাঁর সংকল্প ছিল ১ জানুয়ারি থেকে সব কাজ ফেলে শুধু পড়াতেই মনোনিবেশ করবেন। তিনি সংকল্প রক্ষা করতে পারেননি। এখন কাজ করছেন পরিবেশবিষয়ক একটি এনজিওতে। ২৮ ডিসেম্বর রবিউল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছর আর কোনো সংকল্প করব না। এখন এসব ছেড়ে দিয়েছি। প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা কঠিন।’
রবিউল সংকল্প করেছিলেন একটি তারিখ সামনে রেখে। নতুন বছরে নতুনভাবে কিছু করার জন্য। ১ জানুয়ারিকে সামনে রেখে এ রকম অনেক মানুষ অনেক ধরনের সংকল্প করেন। ধূমপায়ীরা বছরের প্রথম দিন থেকে সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার সংকল্প করেন। তাঁরা প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর সিগারেটে শেষ টান দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। শিক্ষার্থীরা বছরের শুরু থেকেই বেশি পড়াশোনা করবেন, এমন প্রতিজ্ঞা করেন। যাঁরা মুটিয়ে গেছেন, তাঁরা নিয়মিত শরীরচর্চার প্রতিজ্ঞা করেন। যত বদভ্যাস আছে তা ছেড়ে দেওয়ার উপযুক্ত সময় হিসেবে মানুষ বছরের প্রথম দিনটি বেছে নেয়। এখন কথা হচ্ছে, নতুন বছরের এই সংকল্প রক্ষার ক্ষেত্রে মানুষ কতটা সফল হয়?
গবেষণা বলছে, নতুন বছরের সংকল্প সব রক্ষা হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের ৪১ শতাংশ মানুষ নতুন বছরকে সামনে রেখে সংকল্প করে। এদের মধ্যে ৯ শতাংশ সফল হয়েছেন বলে নিজেরা মনে করেন।
নতুন বছরের সংকল্প নিয়ে গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক বাস ভার্পল্যানকেন ও তাঁর সহকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, অভ্যাস ত্যাগ করা বা পাল্টানো খুবই কঠিন কাজ। এমনকি বদভ্যাস ছেড়ে দেওয়ার একটা উপযুক্ত সময় এলেও তা কাজে লাগানো যায় না। ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অনুষ্ঠিত সোসাইটি ফর পারসোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজি বার্ষিক সম্মেলনে তাদের গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।
গবেষকেরা বলছেন, কোনো আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। পারিপার্শ্বিকতা অভ্যাসকে দৃঢ় করে। পারিপার্শ্বিকতায় পরিবর্তন না এলে অভ্যাস বদলানো কঠিন।
৮০০ মানুষের আচরণ নিয়ে গবেষণা করেছেন বাস ভার্পল্যানকেন ও তাঁর সহকর্মীরা। এঁদের একটি অংশ গবেষণা চলার সময় বাড়ি বদল করেছিল, অন্য অংশটি দীর্ঘদিন একই বাড়িতে বসবাস করত। সব অংশগ্রহণকারীকে পানি ও গ্যাস ব্যবহার, যাতায়াত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা—এ রকম ২৫টি বিষয়সংশ্লিষ্ট আচরণ বা অভ্যাস নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা বাড়ি বদল করেছেন তাঁরা আচরণ পরিবর্তনে বেশি সক্ষম হয়েছেন।
গবেষকেরা বলছেন, নতুন বছরের সংকল্প আসলে কাজে আসে না। ৩১ ডিসেম্বর করা অনেক সংকল্প ২ জানুয়ারি অপচয়িত হয় বা নর্দমায় যায়। ৩১ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারির মধ্যে পারিপার্শ্বিকতায় নাটকীয় কোনো পরিবর্তন আসে না। কিন্তু বাড়ি বদল করলে কিছু পরিবর্তন আসে। মানুষ নতুন বাড়িতে সমস্যার সমাধানগুলো নতুনভাবে করে। নতুন বাজার থেকে কেনাকাটা করে, নতুন রাস্তায় যাতায়াত করে এবং এ রকম আরও অনেক কিছু। এই সময় বদ অভ্যাস পরিবর্তনেরও একটা সুযোগ আসে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১ জানুয়ারি তৈরি হয় না।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাটিসটিক ব্রেইন রিসার্চ ইনস্টিটিউট নতুন বছরের সংকল্প নিয়ে গবেষণা করে। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারির তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ৪১ শতাংশ মানুষ নতুন বছরের সংকল্প করে। সংকল্পের শীর্ষ দশের তালিকায় ছিল: ওজন কমানো বা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া, নিজের উন্নতি (বিশেষ করে শিক্ষায়), ভালো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, ধূমপান ত্যাগ, উত্তেজনামূলক কাজ পরিহার, পরিবারের জন্য বেশি সময় দেওয়া, ছুটি নেওয়া, নিজ উদ্যোগে নতুন কিছু শেখা, অন্যের জন্য ভালো কিছু করা ও নিজের জীবনে ভালোবাসার বিষয় খুঁজে বের করা। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ৩৮ শতাংশ নতুন বছরের সংকল্প করে। আর ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে এই হার ১৬ শতাংশ।
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক রাউফুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি মানুষের মধ্যে একাধিক সত্তা থাকে। এসব মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এক সত্তা মানুষকে বদ অভ্যাস ত্যাগ করার জন্য প্রভাবিত করে, মানুষ তখনই সংকল্প করে। মানুষ তখনই সংকল্পচ্যুত হয় যখন বিপরীত কোনো সত্তা প্রকট হয়ে ওঠে।