ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে পোড়া ভবনগুলো ভেঙেচুরে যাওয়া অবকাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাস্তা ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কারের কাজ করছেন।
সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় এক বাসিন্দা আবদুর রহমান বলছিলেন, সবকিছু পরিষ্কার করার কাজ দেখে মনে হচ্ছে যেন সেদিনের ভয়াবহতা আর শোক দ্রুত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলছিলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ভবন হয়তো ভেঙে নতুন ভবন হবে, সামনের সড়ক আবার আগের মতো হবে কিন্তু এই ঘটনায় যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন কিংবা যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের মনের মধ্যে যে ক্ষত তৈরি হলো, তা দূর হবে কীভাবে?
আবদুর রহমানের চকবাজারে দোকান আছে। নিহত কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের তিনি চেনেন।
ঘটনাস্থলে দেখা গেল, চুড়িহাট্টা মসজিদের সামনে পানি ছিটিয়ে ও ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। সিটি করপোরেশনের বড় একটি ট্রাকে পানি এনে রাস্তা ও আশপাশ পরিষ্কার করা হচ্ছে। এর মধ্যে নন্দকুমার দত্ত সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবনের নিচতলা থেকে পুড়ে যাওয়া একটি শিশুর হাতের খণ্ডিতাংশ খুঁজে পান এক ব্যক্তি। এরপর সেদিকে ঘিরে ধরে লোকজন। এ সময় অনেকে মন ভার করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলেন আর আফসোস করছিলেন।
চুড়িহাট্টার যে ভবনগুলোতে আগুন লেগেছে তার মাঝে একটি গোল চত্বর আছে। গোল চত্বরের একপাশে জড়ো করে রাখা হয়েছে আগুনে পুড়ে যাওয়া গাড়ি, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনের অবকাঠামো। ঠিক তার পাশে গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজনের ভিড়। পুরান ঢাকা ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা এসব মানুষ গত বুধবার রাতের আগুনের ভয়াবহতা দেখতে এসেছেন। সবার চোখেই বিস্ময় আর শোকের চিহ্ন।
ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে কথা হচ্ছিল আরিফ হোসেন নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে। তিনি বলছেন, গত পরশু আগুন লাগার পর তিনি বিষয়টি ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি। পরে আগুনের ভয়াবহতা দেখে দূরে ছিলেন। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার একের পর এক মরদেহ দেখে এখন তাঁর কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না, মন খুবই খারাপ লাগছে।
সম্মান তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. নাজিব শাহরিয়ার। তিনি চুড়িহাট্টা এলাকায় একটি মেসে থাকেন। তিনি বলছেন, পুরান ঢাকার বেশির ভাগ বাড়ির নিচে বিভিন্ন ধরনের গোডাউন ভাড়া দেওয়া। এসবের পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, বাসা ভাড়া বা মেস ভাড়া দিলে গ্যাস-পানির সংযোগ দিতে হয়। গোডাউন ভাড়া দিলে এসবের ঝামেলা থাকে না এবং ভাড়াও বেশি পাওয়া যায়। মো. নাজিব শাহরিয়ারের দাবির পক্ষে অনেক প্রমাণও পাওয়া যায়। চুড়িহাট্টা এলাকা চকবাজারের মধ্যে হওয়ায় সেখানে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। তবে এই এলাকা থেকে একটু ভেতরে গিয়েও বিভিন্ন ভবনে বিভিন্ন নামে গোডাউন দেখা গেছে।
সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কাজ চলার সময় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখানে ভবনগুলোর মধ্যে সুগন্ধির ক্যান ছাড়াও লাইটার রিফিল করার ক্যান ছিল। এগুলো সব অবশ্যই কেমিক্যাল।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ করার জন্য ১১ সদস্যর কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি আজ সকাল ৯টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন কমিটির সদস্যরা। এ সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটির সদস্য বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার বিম ও কলাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনের সাপোর্ট ধরে রাখতে পারবে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।
চুড়িহাট্টা মসজিদের জুমার দোয়ায় কান্নার রোল
ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশনের কর্মীরা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন দেখভাল করছিলেন। এর মধ্যে জুমার নামাজের আজান হয়ে যায়। এরপর মসজিদে আসা লোকজনের জন্য আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে থাকে। এ ছাড়া ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজি সেলিমও চুড়িহাট্টা মসজিদে নামাজ পড়েন। এ সময় মসজিদের ইমাম নিয়মিত খুতবা পাঠ করেন।
জুমার নামাজ শেষে ইমাম যখন মোনাজাত ধরেন, তখন মসজিদের বাইরেও অনেক মানুষের জটলা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এসব মানুষও তখন ইমামের সঙ্গে মোনাজাতে শরিক হন। ইমাম যখন মোনাজাত করছিলেন, তখন মসজিদের ভেতর থেকে মুসল্লিদের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। এ সময় চারপাশে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল আর শুধু ইমামের দোয়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। মসজিদের বাইরে থাকা অনেক মানুষ এ সময় অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। অনেকে স্বজন না হারিয়েও ঘটনার ভয়াবহতা আর এত মানুষের মৃত্যুতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
চুড়িহাট্টায় গত বুধবার রাতে আগুনের ঘটনায় ৬৭ জনের লাশ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সেলিম রেজা। এর আগে শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা ৭৮ জন উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আহতের সংখ্যা জানানো হয়েছে ৪১ জন। ঘটনাস্থলে এখনো ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট পর্যবেক্ষণের কাজ করছে। ঘটনাস্থলের চারটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ভবনগুলোতে ব্যানার লাগিয়ে দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।