>• ৩ বছর পর মেয়ে পেল বাবার দেখা
• জেলে আটকে রাখার বিচার ও ক্ষতিপূরণ চান জাহালমের মা ও তাঁর স্ত্রী
• ১ হাজার ৯২ দিন পর বাড়ি ফিরেছেন জাহালম
কাজ শেষে রোজ রাতে বাবা জাহালম তাঁর ছোট্ট মেয়ে চাঁদনীর জন্য কিছু না নিয়ে বাসায় ফিরতেন না। আর সকালে মেয়ের কপালে চুমু দিয়েই কাজে বের হতেন। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটল তিন বছর আগের এক রাতে (৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬)। বাবা আর ফিরলেন না। ঠাঁই হলো জেলখানায়।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। বাবা জাহালমের আর দেখা মেলে না। মেয়ে বাবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। মা ময়না প্রতিরাতেই কথা দেন, কাল অবশ্যই বাবা ফিরে আসবে। শেষ পর্যন্ত মায়ের কথা সত্যি হলো। ১ হাজার ৯২ দিন পর গতকাল সোমবার ভোরে বাবা নাগরপুরের ধুবড়িয়ার বাড়িতে ফেরেন। মেয়ে তখন পাশের গ্রামে নানির কাছে। ততক্ষণে ফোনে মেয়ে জেনে গেছে, বাবা তার ফিরেছে।
সকালের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দাদির বাসায় চলে আসে চাঁদনী, সঙ্গে আসেন নানিও। উঠোনে দাঁড়িয়েই যেন ভড়কে যায় মেয়েটি। একই অবস্থা বাবারও! চাঁদনী এদিক–সেদিক তাকাচ্ছে, বাবাকে খুঁজছে। বাবা কোনটা? প্রায় তিন বছর ও বাবাকে দেখেনি। বাবা যখন গ্রেপ্তার হন তখন ওর বয়স ছিল চার, এখন সাত। শুরুতে মেয়েটি মায়ের সঙ্গে দু–একবার বাবাকে দেখতে জেলখানায় গিয়েছিল। ওখানে ভয় পায় বলে জাহালম তাকে সঙ্গে আনতে বারণ করে দেন।
কাল চাঁদনী প্রথম দেখায় বাবাকে ঠিকমতো চিনতে পারেনি। জাহালম দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরতেই আবেগাপ্লুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এমন সকাল আর কখনো আসেনি ওই গ্রামে। মেয়েকে কোলে নিয়ে সারা পাড়া ঘুরতে থাকেন জাহালম। বাবা মেয়েকে আদর করছিলেন, চুমু খাচ্ছিলেন। মেয়ে চাঁদনীও তখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছিল। ও তখন বলছিল, ‘আমার আব্বু ফিরে এসেছে। আমার খুব ভালো লাগছে।’
জাহালম হাসতে হাসতে পড়শীদের বলে বেড়াচ্ছিলেন, ‘জানেন ভাবি, জানেন চাচি, আমার মেয়ে চাঁদনী প্রথমে দেখে আমায় চিনতে পারেনি।’ বাবার মুখে এমন কথা শুনে অনেকের চোখ ভিজে যায়। প্রতিবেশী রিজিয়া বেগম তখন বলছিলেন, ‘জাহালমের কী কপাল হয়েছে, নিজের মেয়ে তাঁকে চিনতে পারছে না। বিনা দোষে বেচারাকে তিন–তিনটি বছর জেলের ঘানি টানতে হলো!’
জাহালমের স্ত্রী ময়না বেগম নরসিংদীর একটি কারখানায় কাজ করেন। স্বামী ফেরার খবর পেয়ে তিনি দুপুর নাগাদ ধুবড়িয়া গ্রামে ফেরেন। ওই বাড়িতে তখন মানুষ আর মানুষ। সাংবাদিক ও টিভি ক্যামেরার ভিড়। জাহালম একের পর এক সাক্ষাৎকার দিয়েই যাচ্ছিলেন। এমন সময় জাহালম স্ত্রীকে দেখে জড়িয়ে ধরেন। ময়না বলেন, তাঁরা যা আয় করতেন তা দিয়ে ভালোভাবে সংসার চলছিল। কিন্তু বিনা অপরাধে স্বামীকে গ্রেপ্তার করার পর থেকে দুর্বিষহ জীবন শুরু হয় তাঁর। স্বামী জেলে, তিনি গেছেন চাকরিতে, মেয়েকে রেখে যান মায়ের কাছে। মেয়ের সঙ্গে দুই–এক মাস পর দেখা হয়। তিনি এই অন্যায়ের বিচার চান।
জাহালম অনেক আগে থেকে নরসিংদীর ঘোড়াশালে বাংলাদেশ জুট মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পারিবারিকভাবে চাচাতো বোন ময়নাকে বিয়ে করে সংসার পাতেন নরসিংদীতে। সেখানে কারখানার পাশে ঘরভাড়া করে থাকতেন। চাঁদনীর জন্মও সেখানে। সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে দুদকের ২৬ মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ২৮ জানুয়ারি প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি সেদিন হাইকোর্টের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। শুনানি নিয়ে আদালত জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল দেন। এরপর গত রোববার (৩ ফেব্রুয়ারি) শুনানি শেষে হাইকোর্ট জাহালমকে ২৬টি মামলায় অব্যাহতি দিয়ে ওই দিনই মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন।
মায়ের বুকে জাহালম
জাহালম রোববার রাত একটার দিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান। মায়ের বুকে ফেরেন গতকাল ভোর চারটায়, সঙ্গে বড় ভাই শাহানূর এবং পত্রিকা ও টিভির একদল সাংবাদিক। গাড়ি থেকে নেমে মিনিট দুয়েক হাঁটার পর দেখা যায়, অন্ধকারে ঘন কুয়াশায় মুঠোফোনের আলোয় ছুটে এলেন মা মনোয়ারা বেগম। ছেলেকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরলেন মা। বাড়ি থেকে সামান্য দূরে ফাঁকা মাঠে কান্নার রোল...। ছেলের কপালে চুমু দিয়ে চিৎকার দিয়ে মা বলে উঠলেন, ‘কার মাথায় বাড়ি দিছিলাম যে আমার এত বড় সর্বনাশ করেছিল।’ ডুকরে ডুকরে কেঁদে চলেন মা মনোয়ারা। বারবার বলতে থাকেন, ‘আমার সোনার ব্যাটা বিনা দোষে তিন–তিনটা বছর জেল খাটল। আমার সোনার ব্যাটা আজ বাড়ি ফিরল।’ ‘মানষে আমার সর্বনাশ করেছে, আল্লাহ তাগো বিচার করো।’
মনোয়ারা যখন জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছিলেন, তখন জাহালমকে জড়িয়ে ধরেছেন বোন শাহানা ও তাসলিমা। তাঁরাও তখন চিৎকার করে বিলাপ করছিলেন।
জাহালমের দিনগুলো
জাহালমকে নরসিংদী থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় নাগরপুর থানার পুলিশ। এরপর সাত দিন তাঁকে টাঙ্গাইলের কারাগারে রাখা হয়। সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনো ভয়ে কুঁকড়ে যান জাহালম। বলেন, পুলিশ সেদিন জানতে চায়, তিনি আবু সালেক কি না। জবাবে বারবার বলেছিলেন, ‘আমি জাহালম।’ তখন পুলিশ তাঁর কথা বিশ্বাস করেনি। উল্টো বলেছে, ‘সালেক, তোমার নামে ওয়ারেন্ট আছে। অনেক দিন ধরে তোমাকে খুঁজছি।’ এরপর পুলিশ তাঁকে থানা হয়ে আদালতের মাধ্যমে টাঙ্গাইল কারাগারে পাঠায়।
জাহালম বলেন, ‘আমি মানতেই পারতেছিলিম না, আমি কেন জেলখানায়। আমাকে ওয়ার্ডে রাখা হয়। সেখান থেকে আমাকে কাশিমপুর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।’ কারাগার থেকে প্রথম যেদিন ঢাকার আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিন তিনি আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কোনো কথা বলেননি। তবে আসামিদের সঙ্গে একত্রে নিজেকে দেখে তাঁর খুব খারাপ লাগত।
জেলখানায় বেশির ভাগ সময় তিনি একা থাকতেন। কিছুই ভালো লাগত না তাঁর। জেলখানায় একজনের সঙ্গে তাঁর ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে। তাঁর বাড়িও টাঙ্গাইল। বয়সে কয়েক বছরের ছোট তিনি। জাহালম বলেন, ‘আমরা দুই বন্ধু একে অপরের দুঃখের কথা জানাতাম। ও এখনো জেলে আছে।’ দুই–তিন দিন আগে কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক জাহালমকে ডেকে জানিয়ে দেন, তিনি মুক্তি পেতে পারেন। জাহালম বলেন, ‘জেলের অফিসাররা বলেন, পত্রিকায় উঠেছে, এবার ছাড়া পেয়ে যাবা।’
তিন বছর জেল খেটে জাহালম ধুবড়িয়ায় মায়ের বাড়িতে উঠেছেন। ১০ শতাংশ জমির ওপর এই বাড়িটায় তাঁর কোনো মালিকানা নেই। বাড়ির মালিক তাঁর মা ও দুই ভাই শাহানূর ও সাদ্দাম। জাহালম বলেন, ‘জেলখানায় যাওয়ার পর চাকরিটাও চলে গেছে। এখন স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে কীভাবে সংসার চালাব?’ জাহালমের ভাই শাহানূর ও মা মনোয়ারা বলেন, মামলা চালাতে গিয়ে তাঁরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। মনোয়ারা বেগম বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন, সেই কাগজপত্রও দেখান। প্রতিবেশী আফিল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, জাহালমের মামলা চালাতে গিয়ে পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে গেছে। এই কথাটি শুধু আফিলই বলেননি, গ্রামের আরও অনেকেই বলছেন।
আরও পড়ুন: