একাধিক উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ বা কেনার উদ্যোগে ঘাটতি। কবে টিকা আসবে, তা কেউ নিশ্চিত নয়।
দ্রুত টিকা পাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের সামনে বিকল্প কম। বাংলাদেশ মূলত ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকার ওপর নির্ভর করে আছে। সেই টিকা পাওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে আগামী জুনের আগে টিকা সংগ্রহ ও বিতরণের বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ পরিস্থিতিতে সেরামের টিকা না এলে বাংলাদেশকে জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।
সেরামের বাইরে অন্য কোনো বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ বা কেনার উদ্যোগে সরকারের ঘাটতি থাকায় টিকা নিয়ে এই অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, সম্ভাব্য সব উৎস থেকে টিকা কেনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। বাস্তবে প্রাথমিক আলাপ–আলোচনা ছাড়া অন্য কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টিকার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি।
একটি উৎসের ওপর নির্ভর না করে সরকারকে একাধিক উৎসের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হতো।আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ
ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার টিকা বেশ আগেই অনুমোদন পেয়েছে। রাশিয়া ও চীনের টিকা একাধিক দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন অন্তত ৩০টি দেশে বিভিন্ন কোম্পানির টিকা দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে একাধিক কোম্পানির টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে। আগামী দু–এক মাসের মধ্যে আরও কয়েকটি নতুন টিকা ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এসব উৎস থেকে টিকা সংগ্রহে সরকার কী করছে, তা কেউ স্পষ্ট করে বলছেন না।
গত তিন দিনে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের নির্বাহী প্রধান আদর পুনাওয়ালার বক্তব্যকে ঘিরে বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অবশ্য গতকাল মঙ্গলবার তিনি এক টুইটে বলেছেন, সব দেশে করোনাভাইরাসের টিকা রপ্তানির অনুমতি রয়েছে।
ভারতের টিকার চাহিদা মেটানোর আগে অন্য দেশকে বাণিজ্যিকভাবে টিকা না দেওয়ার বিষয়ে পুনাওয়ালার কিছু বক্তব্য ঘিরে বিভ্রান্তি-অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। বার্তা সংস্থা রয়টার্স পুনাওয়ালার সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়ে বলেছিল, আগামী দুই মাসে তাঁরা ভারতের টিকার চাহিদা পূরণ করবেন। ভারত সরকারকে প্রাথমিকভাবে ১০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের পরই টিকা রপ্তানি করা সম্ভব হতে পারে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বেক্সিমকো ফার্মা ও সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারত একই সময় সেরামের টিকা পাবে। বাংলাদেশ টিকার অনুমোদন দেওয়ার এক মাসের মধ্যে সেরাম বাংলাদেশকে টিকা দেবে। প্রথমে ৫০ লাখ টিকা দেবে। পরে প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে মোট ৩ কোটি টিকা দেওয়ার কথা।
অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদন করছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে টিকা কিনছে বাংলাদেশ সরকার। এই টিকা সরবরাহ করবে বেক্সিমকো ফার্মা। এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বেক্সিমকো ফার্মা ও সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যে চুক্তি রয়েছে। এই চুক্তি দুই দেশের সরকারের নাকি বাণিজ্যিক, তা নিয়ে বিতর্কের শুরু হয় গত সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে।
এ সময় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান বলেছিলেন, এটা দুই সরকারের চুক্তি। অন্যদিকে বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এটা বাণিজ্যিক চুক্তি। অবশ্য গতকাল সারা দিন এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আর কোনো বক্তব্য শোনা যায়নি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বেক্সিমকো ফার্মা ও সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারত একই সময় সেরামের টিকা পাবে। বাংলাদেশ টিকার অনুমোদন দেওয়ার এক মাসের মধ্যে সেরাম বাংলাদেশকে টিকা দেবে। প্রথমে ৫০ লাখ টিকা দেবে। পরে প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে মোট ৩ কোটি টিকা দেওয়ার কথা। বেক্সিমকো দেশের জেলা পর্যায়ে সেই টিকা পৌঁছে দেবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, বেক্সিমকোর ভূমিকা মূলত পরিবেশকের।
গতকাল সন্ধ্যায় বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আগেই সেরামের টিকা বুকিং দিয়েছি। এটা আমরা পাবই। দু–একটা আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে সরকার যেদিন চাইবে আমরা সেদিন টিকা আনতে পারব। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’
সেরামের বাইরে বিকল্প হিসেবে সরকারের সামনে আছে কোভ্যাক্স উদ্যোগ। তবে সেখান থেকে আগামী ছয় মাসের আগে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংকসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান মিলে করোনার টিকা সংগ্রহ ও বিতরণের জন্য ‘কোভ্যাক্স’ নামের বৈশ্বিক এই উদ্যোগ গড়ে তুলেছে। এতে যৌথভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে সিইপিআই, গ্যাভি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করা হয়েছে। জুনের মাঝামাঝি সময়ে কোভ্যাক্সের টিকা চলে আসবে। এ ছাড়া অন্য টিকা কেনার চেষ্টা চলছে।আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ,স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১৯০টি দেশ কোভ্যাক্স উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে স্বল্প উন্নত ও মধ্যম আয়ের ৯২টি দেশ ২০২১ সালের প্রথমার্ধে কমপক্ষে ১৩০ কোটি টিকা পাবে। এর মধ্য দিয়ে দেশগুলো তাদের ২০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে পারবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করা হয়েছে। জুনের মাঝামাঝি সময়ে কোভ্যাক্সের টিকা চলে আসবে। এ ছাড়া অন্য টিকা কেনার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ‘আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আরও বেশ কিছু টিকা অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। টিকা কেনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ আছে। সুতরাং টিকা পাওয়া নিয়ে খুব দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’
সম্ভাব্য সব উৎস থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলে আসছেন। এর আগে রাশিয়ার উদ্ভাবিত টিকা কেনার বিষয়েও কথা হয়েছিল। রাশিয়ার স্পুতনিক-৫ টিকার প্রতিটি ১০ ডলার পড়বে বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক একাধিক সভায় বলেছেন, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত—যে দেশ থেকে সম্ভব টিকা আনার চেষ্টা করা হবে।
তবে এসব তৎপরতা এখনো স্পষ্ট নয়। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, সরকারের আরও বিকল্প খোঁজা উচিত ছিল। জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, একটি উৎসের ওপর নির্ভর না করে সরকারকে একাধিক উৎসের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হতো। চীনের কোম্পানি সিনোভ্যাকের সঙ্গে একটি সমঝোতা করে টিকার পরীক্ষার উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের সামনে আরেকটি বিকল্প খোলা থাকত। সেই কূটনীতি জোরদার করতে হতো। অন্যদিকে কোভ্যাক্স থেকে দ্রুততার সঙ্গে বেশি টিকা আনার ব্যাপারে সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।