করোনাকালে দেশে তিন কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছিল। করোনার প্রকোপ কমায় এ সংখ্যা কমে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দেশে ২১ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে।
বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (বিআইজিডি) গবেণায় এ চিত্র পাওয়া গেছে। আজ রোববার এক ভার্চ্যুয়াল সভায় গণমাধ্যমের সামনে এ জরিপের ফল তুলে ধরা হয়।
আজ এ প্রতিবেদন তুলে ধরে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘করোনার পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। নতুন দরিদ্র মানুষের পরিস্থিতির উন্নয়ন হচ্ছে না। দরিদ্র মানুষ টিকে থাকার চেষ্টা করছে স্বশোষণ করে। খাওয়া কমিয়ে, কাজের সময় বাড়িয়ে এ প্রচেষ্টা চলছে।’
দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয় ২০২০ সালের মার্চ মাসে। এরপর নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর করোনার প্রকোপ নিয়ে চার দফা জরিপ করে পিপিআরসি ও বিআইজিডি। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিল, ওই বছরের জুন ও জুলাই, ২০২১ সালের মার্চ এবং সেই বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে চার দফায় সাধারণ মানুষের ওপর করোনার প্রভাব–সংক্রান্ত জরিপ হয়। আজ ‘মূল্যস্ফীতি, খাপ খাওয়ানো ও পুনরুদ্ধারের প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক পঞ্চম দফার ফল প্রকাশ করা হয়। এ দফার জরিপের কাজ চলে গত ১৪ থেকে ২১ মে পর্যন্ত। এ জরিপে অংশ নেয় গ্রাম ও শহরের ৩ হাজার ৯১০ জন।
আজকের অনুষ্ঠানে করোনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত সময়ে গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমা-বাড়া, খাদ্যপণ্যের দামের ওঠানামা, কর্মসংস্থান, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর জন্য মানুষের প্রচেষ্টা, পেশার পরিবর্তনসহ নানা বিষয় উঠে আসে। আজ দুই পর্বে জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। প্রথম দফায় বিআইজিডির পরিচালক ইমরান মতিন সাম্প্রতিক সময়ের প্রভাবগুলো তুলে ধরেন।
তিনি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন, করোনার আগে ২০১৭ সালে দরিদ্র মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১১৭ টাকা। প্রথম লকডাউনের পর এ আয় কমে হয় ৬৫ টাকা। পরে এ আয় বেড়ে ১০৩ টাকা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তা আরও বেড়ে হয় ১০৫ টাকা; কিন্তু এখন তা নেমে গেছে ৯৯ টাকায়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ৬ শতাংশ আয় কমে গেছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, মানুষের আয় করোনাপূর্ব সময়ের চেয়ে এখনো ১৫ শতাংশ কম। শহরে এ হার অনেক বেশি, ২৫ শতাংশ। গ্রামে তা ১ শতাংশ।
জরিপে দেখা যায়, গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের আয় কমেছে অনেক বেশি হারে। দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে শহরের যেখানে আয় কমে যাওয়ার হার ৮, গ্রামে তা ৩ শতাংশ।
ইমরান মতিন বলেন, করোনার পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হলে পরিস্থিতির উন্নতি হয় কিছুটা। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের আয় আবার কমে যায়।
দেখা গেছে, গ্রাম ও শহরের কৃষি ও পরিবহন খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকটা খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছেন। কিন্তু রিকশাচালক, কারখানাশ্রমিক ও গৃহকর্মীর ওপর এর প্রভাব মারাত্মক।
জরিপে বলা হয়, দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে নারীরা নতুন করে কর্মক্ষেত্রে ঢোকার চেষ্টা করছেন। তবে করোনাকালের কাজ হারানো ৩৬ শতাংশ নারী এখনো কর্মক্ষেত্রে ঢুকতে পারেননি।
নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে, নিম্নমানের পণ্য কিনছে বা একেবারে বাদ দিয়েছে। দেখা গেছে, ২৭ শতাংশ পরিবার কম পরিমাণ চাল কিনছে। আগের চেয়ে নিম্নমানের চাল কিনছে ৩৬ শতাংশ পরিবার। কোনো পরিবার একেবারে চাল কিনছে না, তেমনটা দেখা যায়নি। তবে পুষ্টির জন্য দরকারি মাছ, মাংস, দুধ কম কেনা বা একেবারে বাদ দিয়েছে।
দেখা গেছে, ৪৭ শতাংশ ক্ষেত্রে দুধের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। মান কমিয়ে দিয়েছে ২৫ শতাংশ। আর একেবারে বাদ দেওয়া সংখ্যা ২০ শতাংশের মতো পরিবার। ৭৩ শতাংশ ক্ষেত্রে মানুষ মাছ কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। কম কিনছে ৫৬ ভাগ।
জরিপে দেখা যায়, মাসে অন্তত এক দিন শহরের বস্তিবাসীর ৫ শতাংশ মানুষ তাদের আর্থিক দুরাবস্থায় সারা দিন অভুক্ত থেকেছে। গ্রামে এ অবস্থা ৩ শতাংশ। অন্তত একবেলা কম খেয়েছে, এমন পরিবারের সংখ্যা শহরে ২১ এবং গ্রামে ১৩ শতাংশ।
এই যে জিনিসের দাম বাড়ছে, তার পেছনে নানা কারণকে তুলে ধরেছে মানুষ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৬২ শতাংশ মনে করছে দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্যই এমনটা ঘটছে। এর পাশাপাশি সরবরাহের ঘাটতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধিকেও কারণ বলে মনে করেন অনেকে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা হিসেবে সর্বোচ্চ ৬৯ ভাগ মনে করে, ব্যবস্থাপনা বা সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বিস্তারের কথা বলেছে ৩৬ শতাংশ।
করোনার সময় এবং পরে আর্থিক অনটনের সঙ্গে লড়াইয়ে মানুষ কী উপায় বেছে নিচ্ছে, তার চিত্রও উঠে আসে জরিপে। সেখানে গত বছরের আগস্টের সঙ্গে সাম্প্রতিক জরিপের তুলনা করা হয়। দেখা যায়, করোনার সময় যে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা ছিল দুই সময়েই তা কমে গেছে। আগস্ট মাসে ৯১ ভাগ মানুষ নিজের আয়ের ওপরই নির্ভর করে চলত। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯৩ শতাংশ। আগে দোকানে বাকি রেখে বা ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও এখন তা কমে যাচ্ছে। গত আগস্টে ১৭ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়ে চলতে পারত। এখন তা হয়েছে ৭ শতাংশ। পরিস্থিতি এখন এমন হয়ে গেছে যে মানুষ আর ঋণ নিতে চায় না। এর কারণ, তা পরিশোধ তারা করতে পারবে না। শহরের বস্তির ৩১ শতাংশের ঋণ দরকার হলেও তারা তা নিতে পারছে না। ৫১ শতাংশ বলেছে, তারা আর ঋণ চায় না।
পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার খাদ্যবহির্ভূত নানা খাতে মানুষ তাদের ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে বা বাদ দিচ্ছে। ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তারা সন্তানদের জন্য ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। সন্তানের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করেছে ১০ শতাংশ। প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনা কমিয়ে দিয়েছে ১১ শতাংশ ক্ষেত্রে।
ইমরান মতিন বলেন, ‘সন্তানের পড়াশোনার ব্যয় কমানো এবং ওষুধ না কেনার মতো উদ্যোগের বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব আছে।’
নিম্ন আয়ের মানুষ অবস্থা থেকে উত্তরণে ন্যায্যমূল্যে চাল, ১০ টাকার চাল এবং টিসিবির পণ্য কেনার দিকে ঝুঁকেছে। দেখা গেছে, গত বছরের আগস্টে দারিদ্র্যসীমার উপরে থাকা ১৮ শতাংশ মানুষ ন্যায্যমূল্যের চাল কিনত। এখন ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে এ সংখ্যা। এই গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে গ্রামে ১০ টাকার চাল কেনার মানুষের সংখ্যা আগস্টে ছিল ৪ শতাংশ। এটি গত মে মাসে এসে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে। আগস্টে ১৫ শতাংশ মানুষ টিসিবির পণ্য কিনত; কিন্তু মে মাসে এর হার দাঁড়িয়েছে ৩১।
টিসিবির পণ্য কেনা ৬১ শতাংশ মানুষ চায় পণ্যের পরিমাণ বাড়ুক।
করোনাকালের আগে যে পরিমাণ মানুষ কর্মহীন ছিল, এখন তা আরও বেড়ে গেছে বলে উঠে আসে এ জরিপে। দেখা গেছে, করোনার আগে শহরের ৬ শতাংশ মানুষ কর্মহীন ছিল, এখন তা ১০ শতাংশ। গ্রামে করোনার আগে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ৮ শতাংশ। এখন ৯ শতাংশ। করোনা সংক্রমণের পরপরই ২০২০ সালের জুন মাসে ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয় বলে এই দুই প্রতিষ্ঠানের জরিপে বলা হয়েছিল। এ পরিমাণ গত বছরের মার্চ মাসে ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু এখন এ হার ১৮ দশমিক ৫৪।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এখনো তিন কোটি নয় লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে আছে। তাদের এ পরিস্থিতির উত্তরণ হয়নি।