ফরাসি লেখক আঁতোয়ান দ্য সাঁৎ ঝুপেরির দ্য লিটল প্রিন্স ছিল দ্বিজেন শর্মার একান্ত প্রিয় বই। প্রায় যেন রূপকথার বই, কিন্তু জীবন-বাস্তবতা সম্পর্কে গভীরতর উপলব্ধিবহ এমন গ্রন্থ দ্বিতীয় আরেকটি মিলবে না। খুদে রাজকুমারের সেই উক্তি অনুরণন তুলেছিল দ্বিজেন শর্মার অন্তরে, ‘কেবল হৃদয় দিয়েই দেখা যায় সঠিকভাবে’। তারপরই আছে সরল কিন্তু গভীর চিন্তাসম্পন্ন বক্তব্য, ‘জীবনে যা প্রয়োজনীয় সেসব চোখে দেখা যায় না’। আমরা মেতে থাকি দৃশ্যমান বস্তুসামগ্রী নিয়ে আর দ্বিজেন শর্মা খুঁজে ফিরেছেন গাছের পাতার কম্পন, বুঝতে চেয়েছেন কী কথা বলে ফুলদল, জীবন মিলিয়ে নিতে চেয়েছেন প্রকৃতি ও নিসর্গের সঙ্গে এবং অদৃশ্যমান সম্পদের সন্ধান দিতে চেয়েছেন সবাইকে, বিশেষভাবে তরুণদের, কম বয়সীদের, যেমনটি চেয়েছিল লিটল প্রিন্সও। খুদে রাজকুমার মিলিয়ে গিয়েছিল আকাশে, নক্ষত্রলোকে; তেমনিভাবে দ্বিজেন শর্মা দেহত্যাগ করলেন রাত ৩টা ৫০ মিনিটে, নগরী তখন স্তব্ধ, শহরবাসী দিনমান যত ধুলো উদ্গীরণ করেছে, সব থিতু হয়ে মালিন্যমুক্ত আকাশে জ্বলজ্বল করে উঠেছে তারারাজি, এই ছিল শ্রেষ্ঠ সময় আমাদের কালের খুদে রাজকুমারের মহাপ্রস্থানের।
জীবনভর যে সাধনা করেছেন দ্বিজেন শর্মা তার একদিকে ছিল নিসর্গ ও প্রকৃতি, আর অন্যদিকে মানববন্দনা। যৌবনের একেবারে সূচনায় বামপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি, সে জন্য নানা বিড়ম্বনাও পোহাতে হয় তাঁকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিতে এমএসসি করার সময় শৈবাল নিয়ে যে গবেষণাপত্র তিনি তৈরি করেছিলেন, তা নতুন প্রজাতির সন্ধান দিয়েছিল। তবে উচ্চতর শিক্ষা কিংবা গবেষণার সুযোগ তিনি পাননি, পঞ্চাশের দশকের শেষভাগ থেকে দুই দশক তিনি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। এর মধ্যে প্রায় এক যুগ ছিলেন ঢাকার নটর ডেম কলেজে। সেখানে যখন যাঁদের তিনি পড়িয়েছেন, তাঁরা শর্মা স্যারকে কখনো ভোলেননি। এই সময়ে তিনি রচনা করেন ঢাকা শহরের বৃক্ষ ও তরুলতাবিষয়ক তাঁর অনন্য গ্রন্থ শ্যামলী নিসর্গ। চষে বেড়িয়েছেন ঢাকার রাস্তাঘাট, উদ্যান, আর লিখেছেন গাছেদের কথা, বৈজ্ঞানিক বয়ানের সঙ্গে সাহিত্যবোধ মিলিয়ে।
১৯৭৪ সালে মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদকের কাজে যোগদান তাঁর জীবনের আরেক পর্ব সূচিত করে। শিল্প-সাহিত্য, মার্ক্সবাদ-সমাজইতিহাস, শিশু-কিশোর সাহিত্য ইত্যাদি নানা বিষয়ের গ্রন্থ তাঁর অনুবাদে পাঠকের জন্য বিশাল দিগন্ত উন্মোচন করে। সেই সঙ্গে চলে তাঁর নিজের পঠন-পাঠন এবং লেখালেখি। মস্কোতে শর্মা-দম্পতির আবাস হয়ে ওঠে শিক্ষার্থী ছাত্রছাত্রীদের জন্য পরম নির্ভরতার স্থান। মস্কোতে আসা রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, লেখক, শিল্পীদের জন্যও সেই আবাসে মেলে
হৃদয়-প্রসারী আতিথেয়তা। সমাজতন্ত্রের ভূমিতে তিনি গিয়েছিলেন মার্ক্সবাদে তাড়িত হয়ে, সমাজের অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো তখনো প্রকট হয়ে ওঠেনি। এরপর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার পতনেরও সাক্ষী হলেন তিনি। একই সময়ে বিশ্বব্যাপী আমরা দেখেছি পরিবেশের মহাবিপর্যয়, সভ্যতার আরেক সংকট। এই সমুদয় অভিজ্ঞতা দ্বিজেন শর্মাকে হতাশাগ্রস্ত করেনি, কিংবা অন্ধ বিশ্বাসে সমাজতন্ত্রের পুনরুত্থান প্রত্যয়ী করে তোলেনি। তিনি আরও গভীরভাবে বুঝতে প্রয়াসী হয়েছিলেন মানবের স্বভাবধর্ম এবং কাঙ্ক্ষিত সমাজকাঠামোর মধ্যে সামঞ্জস্য রচনার উপায়। পাশাপাশি প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের সমঝোতা রচনার প্রয়াসে তিনি হয়ে ওঠেন আরও উদ্যামী, আরও সৃষ্টিশীল। তাঁর রচনার ফল্গুধারায় আমরা বিভিন্নভাবে স্নাত হতে থাকি।
দ্বিজেন শর্মার লেখালেখিতে এর নানা প্রভাব রয়েছে। সবাই যে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছে, সেটা বলা যাবে না। কৃশকায় এক গ্রন্থ তিনি লিখেছিলেন গহন কোন বনের ধারে নামে, মনে হতে পারে প্রকৃতির পাঠ এই গ্রন্থ। কিন্তু এখানে বিজ্ঞানের সঙ্গে দার্শনিকতা এবং তার সঙ্গে হেঁয়ালি ও কল্পকথার যোগে তিনি মনে হয় মানবজন্মের সার্থকতা অন্যতর অর্থ খুঁজে ফিরেছিলেন। ‘আদিসখা চিরসখা’ শিরোনামের নিবন্ধে তিনি লিখেছেন কুকুর নিয়ে, পৃথিবীর সাহিত্যে কুকুরবিষয়ক সার্থক রচনার তালিকায় এর স্থান হতে পারে। পুরাণে কুকুরের উল্লেখ কীভাবে করা হয়েছে, সেই বিবরণ থেকে তিনি চলে গেছেন মানুষ ও কুকুরের সম্পর্কের ইতিহাস বিষয়ে, তিন হাজার বছরের পুরোনো মিসরীয় পিরামিডে দশ জাতের কুকুর দেখে উৎফুল্ল বোধ করেন তিনি, মেক্সিকোর পিরামিডেও নাকি মিলেছে চিহুয়াহুয়া নামের লিলিপুট কুকুর। এরপর চলে যান সাহিত্যে, জীবনানন্দ দাশের গল্পের কুকুর কেতুর বয়ান দাখিলের পাশাপাশি উল্লেখ করেন ফোকেৎ নামের কুকুরের জন্য মপাসাঁর গল্পের নায়ক ফ্রান্সিসের পাগল হয়ে যাওয়া। উল্লেখ করেন শিয়ালের সঙ্গে ছোট্ট রাজকুমারের কথোকথনের, মানুষ ও প্রাণিজগতের সম্পর্কের আরেক আখ্যান এভাবেই তিনি মেলে ধরেন।
তবে এসবের সবটাই পঠন-পাঠন বা পর্যবেক্ষণের ফল নয়। নিকটজনেরা জানেন পপি নামের এক স্প্যানিয়েল কুকুরকে তিনি কী পরম যত্নে লালন করেছিলেন। আরও বলেছেন, মফস্বলে কলেজে পড়ানোর সময় পাটকিলে ও শাদা মেশানো রঙের চতুরাক্ষ এক কুকুর টমের সঙ্গে তাঁর সঙ্গে সখ্যের কথা। বর্ণনা থেকে মনে হতে পারে, এ কোনো উন্নত জাতের কুকুর। কিন্তু এই টম হচ্ছে একেবারেই দেশি নেড়ি কুকুর। কিন্তু পথের কুকুর ও তার লালনকর্তা দ্বিজেন শর্মার সম্পর্ক বুকে আলোড়ন না জাগিয়ে পারে না। যেমন তিনি বলেছেন, ১১ বছর বয়সে জটিল অসুখ সার্কোমা আক্রান্ত পপির মৃত্যুর কথা। মনে হবে তিনি বলছেন তাঁর কোনো প্রিয়জনের চলে যাওয়ার কথা, লিখেছেন, ‘দুরারোগ্য ক্যানসার, খুব কষ্ট পায়নি। অন্তত ডাক্তাররা সেই আশ্বাস দিয়েছিলেন। প্রচলিত নিয়ম ভেঙে রাতে লুকিয়ে তাকে কবর দিয়েছিলাম আমাদের বারোয়ারি ফ্ল্যাটবাড়ির নিচের বাগানের বার্চ বনে। আইনভঙ্গ? অবশ্যই, তবে ভালোবাসার জন্য ছোটখাটো বেআইনি কাজ দূষণীয় নয়, ভেবেছি, এভাবেই পপি আমার কাছে থাকবে, যাতায়াতের সময় রোজই কবরটি দেখব। ভাবব, আমার পপি শুয়ে আছে আমারই লাগানো বার্চগাছের তলে। তাদের শেকড়ের সঙ্গে মিতালি পাকিয়ে। কবছর হলো ও কবরে একটি লাইলাক গাছ লাগিয়েছি। ওটাই পপির স্মৃতিস্তম্ভ—নাই বা থাকল নাম লেখা কোনো ফলক।’
দ্বিজেন শর্মা কোন মনের অধিকারী, এই পরিচয় পাওয়া যায় ছোট্ট এই নিবন্ধে। আরও বুঝতে পারা যায় মানবেতিহাস ও জীবনযাপনের কোন সমীকরণ নির্মাণে তিনি আগ্রহী ছিলেন। অগ্রগতির নামের প্রকৃতির ওপর বিজ্ঞান–লব্ধ জ্ঞানের আধিপত্য বিস্তার তাঁকে চিন্তিত করেছিল বহুকাল আগে থেকে। রাচেল কারসনের সাইলেন্ট স্প্রিং ছিল তাঁর আরেক প্রিয় বই। পরবর্তী সময়ে তাঁর এই উপলব্ধি আরও গভীর হয়েছে এবং পূর্বোক্ত গ্রন্থে ‘সুদূর কোন বনের ধারে’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার শৈবাল সন্ধানকালে এক খ্যাপাটে বুড়োর সাক্ষাৎ পাওয়ার কথা লিখেছিলেন। কল্পিত এক চরিত্র বটে, তবে মনে হবে এ যেন থরোর সেই ওয়ালডেন, সভ্যতা থেকে দূরে যে প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের অন্য পাঠ তৈরি করতে চায়। এই চরিত্রের নাম তজব তরফদার ‘আজব খোয়াব’ নামে যার এক খাতা লেখকের হস্তগত হয়, যে খাতার সূচনায় লিপিবদ্ধ আছে পেরুতে পাওয়া চতুর্থ শতকে এক কলসিতে উৎকীর্ণ বাণী: ‘এমন একদিন আসিবে, যখন মানুষের সৃষ্ট সমুদয় বস্তুপুঞ্জ এ সকল গৃহপালিত প্রাণী—মাটির বাসন, কড়াই, হাঁস, কুকুর, মুরগি শোষকদের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইবে এবং নিজের মাথার বোঝা মানুষের মাথায় চাপাইবে। মাটির বাসন মানুষকে আগুনে তাতাইবে, মুরগিরা তাহাকে খুন করিলে এবং কড়াই তাকে ভাজিবে। এই ঘটনা একবার ঘটিয়াছিল, আবারও ঘটিবে।’
এমনই গভীর ভালোবাসা ও উপলব্ধি নিয়ে জীবন অবলোকন করেছিলেন দ্বিজেন শর্মা। সমাজতন্ত্রের পতন তার কাছে পুঁজিবাদের বিজয় হিসেবে প্রতিভাত হয়নি, তিনি একে দেখেছেন আরও গভীর সংকটের প্রকাশক হিসেবে, মানবসভ্যতা সমীকরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রকৃতি, জীবন ও মানবসত্তার মধ্যে। বিগত বছর সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের বরিশাল জেলা সম্মেলনে গভীর দার্শনিক বোধ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রকৃতিকে অবদমনের মাধ্যমেই মানবসভ্যতার নির্মাণ ও উন্নয়ন ঘটেছে। আজ প্রকৃতি সংহারমূর্তি ধারণ করেছে, আমরা একটি সম্ভাব্য মহাপ্রলয়ের আশঙ্কায় হতবুদ্ধি অবস্থায় রয়েছি।’
দ্বিজেন শর্মা ছিলেন একাধারে খুদে রাজকুমার, থরোর ওয়ালডেন এবং সুনামগঞ্জের তজব তরফদার। আশার কথা যে, তাঁর কাছ থেকে প্রকৃতির এবং জীবনদর্শনের পাঠ নেওয়ার মতো অনেক নবীন-নবীনা তৈরি হয়েছে দেশে। এমন মানুষের কৃতি তাই কখনো মুছে যাওয়ার নয়। তিনি আজ নেই, কিন্তু তাঁকে আজ আমাদের আরও অনেক বেশি প্রয়োজন।