এটি এখন কেবলই একটি পরিত্যক্ত বাড়ি। পেছনে এক দঙ্গল আগাছা। ভবনের গায়ে লতা-গুল্ম, ফাঙ্গাস।
অথচ ইট-সুরকির গাঁথুনিতে পুরু দেয়ালের দ্বিতল এই বাড়িটিতে একসময় আনন্দের হিল্লোল উঠত। জমিদার, তাঁর পুত্র-কন্যা, পাইক-পেয়াদা মুখর করে রাখতেন বাড়িটি। উপমহাদেশের অনেক বিখ্যাত শিল্পী এই বাড়িতে বসে গান করেছেন।
‘বড় উঠান মিয়া বাড়ি’ নামে পরিচিত এ বাড়িটির প্রতিষ্ঠাতা রাজা শ্যামরায়। বাংলার নবাব শায়েস্তা খাঁ যখন চট্টগ্রাম বিজয় করেন, তখন তাঁর প্রধান সেনাপতি ছিলেন বড় ছেলে বুজুর্গ উমেদ খান। উমেদ খানের সহযোগী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন রাজা শ্যামরায়। পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দেওয়ান মনোহর আলী খান নাম নেন। পরিবারটির বয়স ৩৬০ বছরের ওপরে। এই পরিবারের ১৬তম প্রতিনিধি সাজ্জাদ আলী খান (মিঠু)। তিনি থাকেন চট্টগ্রাম শহরে। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে গ্রামে যান। ৭০ থেকে ৭৫ বছর বাড়িটি পরিত্যক্ত পড়ে আছে।
রাজা শ্যামরায়ের পরগনার নাম ছিল দেয়াঙ পরগনা। দেয়াঙ পাহাড়ের পাদদেশে এর অবস্থান। এখন জায়গাটি পড়েছে নবগঠিত কর্ণফুলী উপজেলার ২ নম্বর বড় উঠান ইউনিয়নে।
গত ১৮ জুলাই রাস্তার পাশে গ্রামীণ বাজার, সরু সড়ক ধরে পৌঁছে যাই জমিদারবাড়িতে। বাড়ির সামনে বিরাট দিঘি। এক পাশে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ধবধবে সাদা ইলিয়াছ খান মসজিদ। মূল কাঠামো অবিকৃত রেখে এখন মসজিদটির সামনের দিকে বাড়ানো হচ্ছে।
রাজা শ্যামরায় মূলত চট্টগ্রামের রাউজানের মানুষ। তাঁর সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে। নবাব শায়েস্তা খাঁ একদিন রাজার ক্ষমতা পরীক্ষা করার বুদ্ধি আঁটেন। শায়েস্তা খাঁ বলেন, এক রাতের মধ্যে শ্যামরায় যদি নবাবের বাড়ির সামনে একটি দিঘি খনন করে তাতে প্রস্ফুটিত পদ্ম দেখাতে পারেন, তবে তিনি আনন্দিত হবেন। সকালে নবাব দেখেন সত্যি সত্যি তাঁর বাসস্থানের সামনে এক বিস্তীর্ণ দিঘিতে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল। কমলদহ দিঘি নামে সেটি আজও আছে চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে।
রাজা শ্যামরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাঁর পরিবারের আর কোনো সদস্য সধর্ম ত্যাগ করেননি। সাংবাদিক জামালউদ্দিনের লেখা দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস বই থেকে জানা যাচ্ছে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর মুসলিম নারীকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন শ্যামরায়। খবর পৌঁছে যায় শায়েস্তা খাঁর কাছে। অবশেষে শায়েস্তা খাঁ নিজ কন্যার সঙ্গে মনোহর আলী খানের বিয়ে দিতে সম্মত হন। এই বিয়ের মধ্য দিয়ে নবাব পরিবারভুক্ত চট্টগ্রামের জমিদারির এক-চতুর্থাংশ লাভ করেন মনোহর আলী খান ও তাঁর স্ত্রী। সেটা ১৬৬৬ সালের কথা।
এই পরিবারটিকে বলা হয় চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদার পরিবার। একসময় তাঁদের জমিদারি হাতিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। খাজনা আদায়ের সময় (পুণ্যাহ) ভারতবর্ষের সেরা শিল্পী, বাদক দল এ বাড়িতে এসে মাতিয়ে রাখত। এর বাইরে সারা বছর নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো।
এই পরিবারের সদস্যরা ছিলেন ধর্মভীরু। চট্টগ্রামজুড়ে একাধিক ঐতিহাসিক মসজিদ, দিঘি, সড়ক, হাটবাজারসহ বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠান তাঁরা তৈরি করেছেন।
সাজ্জাদ আলী খানের সঙ্গে কথা হলো টেলিফোনে। তিনি জানালেন, ‘শায়েস্তা খাঁর এক কন্যার সঙ্গে মনোহর আলী খানের বিয়ে হয়েছিল, সেটা সত্য। তবে সেই কন্যার নাম পরীবিবি নয়। অনেকে বলেন, তাঁর নাম ছিল নূরজাহান। তবে বিষয়টি আমরা আজ অবধি নিশ্চিত হতে পারিনি।’ পরীবিবি ছাড়া শায়েস্তা খাঁর আর কজন কন্যা ছিল তাও ঠিকঠাক জানা যায় না।