বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চল এবং মিয়ানমারের কিছু অংশে প্রচণ্ড শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প হতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলটির বিস্তার প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। এতে প্রায় ১৪ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রায় ১২ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে এ তথ্য পেয়েছেন। তাঁদের গবেষণা প্রতিবেদনটি নেচার জিওসায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশ হয়। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশসহ ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অংশজুড়ে একটি সুবিশাল চ্যুতির (ফল্ট) অবস্থানের কারণে এই এলাকায় রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এ রকম দুর্যোগে ঢাকাসহ বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও বিপুল প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। ফল্ট এলাকার আশপাশের ১০০ কিলোমিটার এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে।
নেচার জিওসায়েন্সে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জলমগ্ন এই নিম্নাঞ্চলে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এক হয়ে বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ গঠন করে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। এই যৌথ নদীপ্রবাহে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পলিমাটি জমে। নিরবচ্ছিন্ন এই পলি-স্তূপের কারণে গাঙ্গেয় বদ্বীপের নিচের ভূপ্রকৃতি ব্যতিক্রমী ধরনের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, পললভূমির নিচে অবস্থিত টেকটোনিক প্লেটগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে থাকে।
ভূত্বকের নিচের অবস্থা জানতে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূপদার্থবিদ মাইকেল স্টেকলারের নেতৃত্বে গবেষক দল বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় অতি সংবেদনশীল বেশ কিছু জিপিএস যন্ত্র স্থাপন করে। ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওই গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকও অংশ নেন। প্রতিবেশী দেশ
ভারত ও মিয়ানমারেও এ রকম কিছু যন্ত্র বসিয়ে সমগ্র ফল্ট অঞ্চলের একটি মানচিত্র তৈরি করা হয়। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমসের (জিপিএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি টেকটোনিক প্লেট আরেকটির নিচের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর সেগুলোর অবস্থান বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও পূর্ব ভারতজুড়ে বিস্তৃত একটি অঞ্চলের নিচে। ফল্টের ওপরের স্তরে দুটি প্লেট পরস্পর লেগে আছে। এতে সৃষ্ট চাপের প্রভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী ভূকম্পন হতে পারে।
স্টেকলার বলেন, বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে নানা সমস্যা ধরা পড়েছে। সেখানে বালু ভরাট করে ২০ তলা ভবন নির্মাণ করতেও দেখা যায়। ভূমিকম্প হলে এ রকম ভবন সহজেই ধসে পড়বে। এ ছাড়া অতিরিক্ত জনবহুল হওয়ায় সেখানে ভূমিকম্প হলে প্রাথমিক উদ্ধার তৎপরতায় বিঘ্ন হতে পারে। এখন স্বাভাবিক অবস্থায়ই ঢাকা শহরে যানবাহন চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। সেখানকার রাস্তায় যদি ভূমিকম্পের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে, ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো এবং উদ্ধার তৎপরতা চালানো সত্যিই অসম্ভব কাজ হবে। তবে এই ভূমিকম্প ঠিক কখন হতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এটা আগামীকালই হতে পারে, আবার ৫০০ বছর পরেও হতে পারে।
গবেষণাপত্রটি আরও বলছে, অনিয়ন্ত্রিত ভবন ছাড়াও ভূমিকম্পে ভারী শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রগুলো ধ্বংস হতে পারে।
গবেষক দলের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেছেন, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ১৯ কিলোমিটার গভীর পলি জমে বাংলাদেশের যে ভূখণ্ড তৈরি হয়, তা সেই ভূমিকম্পের প্রভাবে কেঁপে উঠতে পারে এবং এর প্রভাবে বিভিন্ন জায়গা তরলে পরিণত হতে পারে। এতে সেখানকার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট এবং লোকজন তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
নেপালে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ২০১৫ সালের এপ্রিলে যখন আঘাত হানে, বাংলাদেশে তখন কয়েকটি ভবন হেলে পড়ে এবং ফাটল ধরে। এতে অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয়। আতঙ্ক, হৃদ্রোগ ও পদদলনই তাঁদের মৃত্যুর কারণ। গত বছরের ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৯।
গবেষণার বিষয়ে কিছুটা দ্বিমতও রয়েছে
প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে কিছুটি দ্বিমত করেছেন বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী। ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে সে সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ গবেষণায় যে ফাটলরেখা দেখানো হয়েছে, তার বাইরেও একটা ফাটলরেখা মিয়ানমারের সমান্তরালে চলে গেছে। সেখানে গত কয়েক শতাব্দীতে বড় ধরনের অনেক ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু এই গবেষণায় যে ফাটলরেখা দেখানো হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের প্রায় মাঝ বরাবর চলে গেছে। এই রেখার ওপর অতীতে কোনো বড় ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য মেলেনি।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে গ্লোবাল আর্থকোয়েক মডেল প্রকাশিত এক গবেষণার বরাত দিয়ে বুয়েটের এই অধ্যাপক আরও বলেন, বাংলাদেশের উত্তরে ভুটান এলাকায় ২৫ কিলোমিটার লম্বা একটি ফাটলরেখা আছে। সেখানে যেকোনো সময় ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।