সাধারণ সময়ের তুলনায় এ বছর প্রবাসী কর্মীদের ফেরার হার পাঁচ গুণ। দেশেই অনেক বেকার। ফেরত আসা কর্মীরা কাজ পাচ্ছেন না।
স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এ বছর প্রবাসী কর্মীদের দেশে ফেরার হার পাঁচ গুণ। গত জানুয়ারি থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। ২০১৯ সালে পুরো বছরে সংখ্যাটি ছিল ৬৫ হাজারের নিচে।
বেশির ভাগ প্রবাসী কর্মী ফিরেছেন করোনাকালে কাজ হারিয়ে। কেউ কেউ ছুটিতে এসে আর যেতে পারছেন না। কাউকে কাউকে বৈধতা না থাকায় ফিরতে হয়েছে। সমস্যা হলো, এই বিপুলসংখ্যক কর্মীর আবার বিদেশ যাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে। দেশেও তাঁরা কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না। দীর্ঘ সময় ধরে আয়হীন এসব কর্মীর পরিবার সংকটে পড়েছে।
আয়হীন কর্মীদের একজন নরসিংদীর মনসুর আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কাতার থেকে ফেরার পর তিনি আট মাস ধরে বেকার। কিছু জমানো টাকা ছিল, তাও শেষ। এখন পরিবার নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন।
সব দেশ মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি কর্মী ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে, প্রায় ৬১ হাজার। এরপর রয়েছে যথাক্রমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, মালদ্বীপ, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ইরাক ও লেবানন
দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, গত কয়েক মাসে ফেরত আসা কর্মীর হার আরও বেড়েছে। সদ্য শেষ হওয়া অক্টোবর মাসের প্রথম ২৪ দিনের হিসাব বলছে, এ সময়ে দেশে ফিরেছেন প্রায় ৬০ হাজার কর্মী। এখন দিনে গড়ে প্রায় আড়াই হাজার কর্মী ফিরছেন। এ প্রবণতা চলতে থাকলে বছর শেষে ফিরে আসা কর্মীর সংখ্যা চার লাখ ছাড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।
বিদেশে কর্মী পাঠানো নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ থাকলেও কাজ হারিয়ে ফিরে আসা কর্মীদের পুনর্বাসনে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। অভিবাসন খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশনসের (ডেভকম) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশে কর্মী পাঠানো নিয়ে সবাই কাজ করে। কিন্তু ফিরে আসা কর্মীদের কর্মসংস্থান তৈরি নিয়ে দেশে তেমন কোনো কাজ হয় না। তিনি বলেন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন অনেক আগে থেকে পুনর্বাসনের কাজটি শুরু করেছে। এটি শুধু সরকারের কাজ নয়। সবার এদিকে মনোযোগ দিতে হবে।
প্রবাসী কর্মীরা বেশি ফিরছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। আর ফেরার প্রবণতা করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর বেড়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর মার্চে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এপ্রিল থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ফিরতে শুরু করেন প্রবাসীরা। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ১ এপ্রিল থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ফিরে আসেন প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার প্রবাসী।
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের তথ্য বলছে, অধিকাংশ প্রবাসী ফিরছেন বাধ্য হয়ে, কাজ হারিয়ে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরা কর্মীদের মধ্যে কারও ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কারও ইকামা (কাজের বৈধ অনুমতিপত্র) নেই। আবার কাউকে কাউকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে দেশে পাঠিয়েছেন নিয়োগকর্তা।
সব দেশ মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি কর্মী ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে, প্রায় ৬১ হাজার। এরপর রয়েছে যথাক্রমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, মালদ্বীপ, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ইরাক ও লেবানন।
ফিরে আসা কর্মীদের মধ্যে ২৫ হাজার ৪৩৬ জন নারী। বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অভিবাসী নারী কর্মীদের কাছ থেকে দিনে ৩০ থেকে ৪০টি ফোনকল পাচ্ছেন, যাদের বড় অংশ বেকারত্বের কথা জানায়। তিনি বলেন, দেশে ফিরে আসার পর প্রবাসী নারী কর্মীদের আয়হীন সংসারে চলছে দুরবস্থা।
ফিরে আসা কর্মীদের পুনর্বাসনে ৭০০ কোটি টাকার তহবিল তৈরি করছে সরকার। ঋণসহায়তা দিতে গত জুলাইয়ে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ তহবিলে আরও ৫০০ কোটি টাকা যুক্ত হবে। এ তহবিল থেকে প্রবাসী পুনর্বাসন ঋণ নামে ৪ শতাংশ সরল সুদে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পাবেন প্রবাসীরা। ১৫ জুলাই থেকে আবেদন সংগ্রহ করা হলেও ঋণ ছাড় হয়েছে খুবই কম। এখন পর্যন্ত ১ কোটি টাকার মতো ছাড় হয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রবাসীরা বলছেন, ব্যাংকে যোগাযোগ করলেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার জটিলতায় ঋণ নিতে পারছেন না তাঁরা। ময়মনসিংহের রিপন আহমেদ নামের এক ব্যক্তি বলেন, সব নথি জমা দিয়েছেন। ব্যাংক ঋণ দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত পাননি। তাই আবার সৌদি আরব যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা ফিরে এসেছেন তাঁদের কোনো না কোনো কাজে দক্ষতা তৈরি হয়েছে বিদেশে। তাঁদের তিন দিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ কর্মীর সনদ দেওয়া হবে, যাতে ভবিষ্যতে তাঁরা দক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশে যেতে পারেন। আর যাঁরা দেশে ব্যবসা বা কোনো উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হতে চান, তাঁদের জন্য সরকার ঋণের ব্যবস্থা করেছে। আবেদন করলে তাঁদের জন্যও বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
ফিরে আসা কর্মীদের তথ্যভান্ডার বা ডেটাবেইস তৈরির জন্য শুরু থেকেই পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অবশেষে গত ৬ অক্টোবর থেকে প্রবাসীদের নিবন্ধন শুরু করেছে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। ছুটিতে আসার পর বিভিন্ন জটিলতায় ফিরে যেতে না পেরে দেশে আটকে পড়া এবং ফিরে আসা অসহায় কর্মীদের নিবন্ধন করতে বলা হয়েছে। এ তালিকা ধরে তাঁদের সহায়তার চিন্তা করছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
এর আগে গত ১ জুলাই মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে একটি চিঠি দিয়ে বিদেশ থেকে ফিরে আসা অসহায়, ক্ষতিগ্রস্ত ও দরিদ্র কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষাসহ মানবিক সহায়তা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
অবশ্য ফিরে আসা প্রবাসীরা তেমন কোনো সহায়তা না পাওয়ার কথাই বলছেন। দেশে ফিরে আসা ১৮ জন প্রবাসীর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। কেউ কোনো সহায়তা পাননি বলে দাবি করেন। এর মধ্যে শরীয়তপুরের জাকির হোসেন ১৩ বছর কুয়েতে ছিলেন। করোনাকালে পাঁচ মাস বেকার থাকার পর আগস্টে দেশে ফেরেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ফিরে তিনি কোনো কাজে যুক্ত হতে পারেননি। ৯ সদস্যের সংসার চলছে টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে।
করোনাকালে দেশে ফেরা প্রবাসী কর্মীদের অবস্থা উঠে এসেছে তিনটি জরিপে। এর মধ্যে আগস্টে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) এক জরিপ বলছে, দেশে ফেরা ৭০ শতাংশ প্রবাসী কর্মী জীবিকা নিয়ে সংকটে রয়েছেন। অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) জুলাইয়ে একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, জরিপকালে ৬১ শতাংশ কর্মীর পরিবারে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আসা পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
এর আগে মে মাসে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপে উঠে এসেছিল, দেশে ফেরা ৮৭ শতাংশ প্রবাসীর আয়ের কোনো উৎস নেই। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির আওতায় বিদেশফেরত কিছু কর্মীকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে, যাতে তাঁরা ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিদেশে যেতে পেরেছেন মাত্র ১ লাখ ৮০ হাজার কর্মী। এরপর থেকে বিদেশে যাওয়া কার্যত বন্ধ ছিল। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পুরোনো কর্মীদেরই অনেকে ফেরত যেতে পারছেন না। মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার বন্ধ। অন্যান্য দেশেও পরিস্থিতি একই
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশফেরত কর্মীরা আবার বিদেশেই কাজের জন্য যেতে চান। সম্প্রতি বিভিন্ন জরিপেও তা উঠে আসে। বর্তমানে বিপুলসংখ্যক কর্মী বিদেশে যেতে উন্মুখ থাকায় মানব পাচারের ঝুঁকিও বেশি।
বেসরকারি সংস্থা অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেশে ফেরার পর কোনো কাজ পান না অভিবাসীরা। হতাশা, অভাব থেকে ধারদেনা করে হলেও পুনরায় অভিবাসনের উপায় খুঁজতে থাকেন। এতে করে অনেকে নিজ থেকেই মানব পাচারকারীর হাতে ধরা দেন। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সামনে অভিবাসনের চেয়ে মানব পাচার বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৭ সালে কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ৬ কোটি ৮ লাখ কর্মী। বেকার ছিলেন ২৭ লাখ। প্রাক্কলন অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন। এর মধ্যে ১৩ লাখের মতো দেশেই কাজ পান। বাংলাদেশ থেকে কাজের খোঁজে বিদেশে যান বছরে প্রায় ৭ লাখ মানুষ। এঁরা স্থানীয় শ্রমবাজারের ওপর চাপ ফেলেন না।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিদেশে যেতে পেরেছেন মাত্র ১ লাখ ৮০ হাজার কর্মী। এরপর থেকে বিদেশে যাওয়া কার্যত বন্ধ ছিল। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পুরোনো কর্মীদেরই অনেকে ফেরত যেতে পারছেন না। মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার বন্ধ। অন্যান্য দেশেও পরিস্থিতি একই।
অভিবাসী নারী কর্মীদের কাছ থেকে দিনে ৩০ থেকে ৪০টি ফোনকল পাচ্ছি আমরা, যাদের বড় অংশ বেকারত্বের কথা জানানফরিদা ইয়াসমিন, বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক
এদিকে দেশেও করোনাকালে অনেকে কাজ হারিয়েছেন। শ্রমজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আয় কমেছে। তাই বিদেশফেরত কর্মীরা অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারেও কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না।
সার্বিক বিষয়ে রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশফেরত কর্মীর অবস্থা বুঝে পরিকল্পনা নিতে হবে। চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো। আর ব্যবসা করতে হলে আগে প্রশিক্ষণ লাগবে। এটা দ্রুত করা দরকার। তিনি বলেন, উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত হতে না পেরে খারাপ অবস্থা পার করছে প্রবাসীদের পরিবার।