পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নিয়ে পৃথক মামলা হাইকোর্টের কোম্পানি বেঞ্চে বিচারাধীন।
পি কে হালদার নামে পরিচিত প্রশান্ত কুমার হালদারকে গ্রেপ্তার ও দেশে ফিরিয়ে আনতে দেড় বছর আগে স্বতঃপ্রণোদিত রুল দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এই রুলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। এর মধ্যেই গত শনিবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছেন পি কে হালদার। বাংলাদেশে আর্থিক খাতে আলোচিত এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করার অভিযোগ রয়েছে।
২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর ‘পি কে হালদারকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবে দুদক’ শিরোনামে একটি দৈনিকে প্রতিবেদনে ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি বিবেচনায় নিয়ে ওই বছরের ১৯ নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন।
সেদিন শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেছিলেন, ‘দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করবে কেউ, আর সে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে, মগের মুল্লুক নাকি? কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তাকে অবশ্যই দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তাকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।’
হাইকোর্টের দেওয়া রুলে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার ও দেশে ফিরিয়ে আনতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা-ব্যর্থতা কেন বেআইনি হবে না এবং এ ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
মামলাটি যাতে কার্যতালিকায় আসে, সে জন্য আজ আবেদন করা হবে। আইনি প্রক্রিয়ায় পি কে হালদারসহ তাঁর সহযোগীদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে।এ কে এম আমিন উদ্দিন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
পি কে হালদার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেডসহ (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (পিএলএফএসএল), এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)—এই চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তবে কোনো প্রতিষ্ঠানেই তাঁর নিজের নামে কোনো শেয়ার ছিল না। মূলত এই চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এবং পিপলস লিজিং নিয়ে পৃথক মামলা হাইকোর্টের কোম্পানি বেঞ্চে বিচারাধীন। অন্যদিকে হাইকোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত রুলের পর পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলার তদন্ত ও তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে ইন্টারপোলের কাছে পাঠানোর অগ্রগতি সম্পর্কে শুনানি হয় গত বছরের ৩ জানুয়ারি।
সেদিন পি কে হালদারের দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিংয়ে আমানতকারী চার ব্যক্তি তাঁদের অর্থ ফেরত পেতে আদালতে আরজি জানান। পরে আমানতকারীরা লিখিত আবেদন করেন। এর শুনানি নিয়ে গত বছরের ৫ জানুয়ারি হাইকোর্টের একই বেঞ্চ পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যাতে বিদেশে না যেতে পারেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
মামলার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, লীলাবতী হালদার দেশ ছেড়ে কানাডায় চলে গেছেন।
ওই আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে নিয়োজিত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সর্বশেষ গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর মামলাটি কার্যতালিকায় ছিল। পি কে হালদার ও তাঁর পাঁচ সহযোগীকে ১৪ মে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) গ্রেপ্তার করেছে। বিষয়টি আদালতকে অবহিত করাসহ মামলাটি যাতে কার্যতালিকায় আসে, সে জন্য সোমবার (আজ) আবেদন করা হবে। আইনি প্রক্রিয়ায় পি কে হালদারসহ তাঁর সহযোগীদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে।
অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পিপলস লিজিং ২০১৯ সালে অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। অবসায়ন বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে ১৪ জুলাই হাইকোর্টের কোম্পানি বেঞ্চ এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একজন ‘সাময়িক অবসায়ক’ নিয়োগের অনুমতি দেন। এরপর সাময়িক অবসায়ক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক মো. আসাদুজ্জামানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তবে পিপলস লিজিং পুনর্গঠন বা পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশনা চেয়ে ২০১ জন আমানতকারী কোম্পানি কোর্টে আবেদন করেন। এই আবেদনের শুনানি নিয়ে গত বছরের ১২ জুলাই বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের একক কোম্পানি বেঞ্চ ১০ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে আদেশ দেন। পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামাল উল আলমকে। পিপলস লিজিংয়ে সাময়িক অবসায়ক (প্রবেশনাল লিকুইডেটর) নিয়োগ–সংক্রান্ত ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই দেওয়া আদেশ প্রত্যাহার করে ওই পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম আইনজীবী কাজী এরশাদুল আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্ট ১০ সদস্যের বোর্ড গঠন করে দিয়েছেন, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চলছে। তবে পিপলস লিজিং অবসায়ন প্রশ্নে করা মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।
আদালতের গঠন করে দেওয়া পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ চলতি বছরের ১৫ জুলাই পর্যন্ত বলে জানান পিপলস লিজিং আমানতকারী ২০১ জন আবেদনকারীর আইনজীবী শামীম আহমেদ।
এদিকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে জমা রাখা টাকা ফেরত পেতে ও এর অবসায়ন চেয়ে আমানতকারীদের কয়েকজন ২০১৯ সালের শেষ দিকে হাইকোর্টের কোম্পানি বেঞ্চে আবেদন করেন। ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি কোম্পানি বেঞ্চ কয়েক দফা নির্দেশনাসহ আদেশ দেন।
হাইকোর্ট পি কে হালদার, তাঁর পরিবারের সদস্য এবং প্রতিষ্ঠানটির সে সময়কার চেয়ারম্যান, এমডি ও পরিচালকসহ ২০ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও সব সম্পত্তি হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দেন। হাইকোর্ট ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হিসেবে সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। পরে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন। (উল্লেখ্য, খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ গত বছর মারা গেছেন)।
ইব্রাহিম খালেদের পর ২০২০ সালের ১৯ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান ও স্বাধীন পরিচালক হিসেবে সাবেক সচিব এন আই খানকে নিয়োগ দেন হাইকোর্ট। সর্বশেষ গত বছরের ১৬ জুন পরিচালনা পর্ষদে নতুন পাঁচজন স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ দেন হাইকোর্ট।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের আইনজীবী মাহফুজুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি অবসায়ন চেয়ে আমানতকারীদের করা মামলাটি চলমান রয়েছে। আমানতকারীদের জমানো টাকা ফেরত দেওয়াসহ সার্বিক কার্যক্রম দেখছে আদালত–নিযুক্ত পরিচালনা পর্ষদ।
আজ প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় এই প্রতিবেদনে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিনের নাম ভুল করে এ এম আমিন উদ্দিন লেখা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত।