করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব (সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং) বজায় রাখাকে এখনো অন্যতম সেরা পন্থা বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা বা নির্দেশনা নেই। তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য কারখানা খুলে দেওয়ায় বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে গেছে, এমন বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ সীমিত পর্যায়ে রাখার পথ এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
জীবন ও জীবিকা—এই দুইয়ের মধ্যে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এ নিয়ে ব্যাপক ও বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা ছাড়াই পোশাকশ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বলা হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েছেন। পোশাক কারখানা খোলার সংবাদে অন্য শিল্পকারখানা ও অফিস খোলার কথা শোনা যাচ্ছে। বাজারঘাটে মানুষের ভিড় বাড়ছে। গণপরিবহনে মানুষ ধাক্কাধাক্কি করে উঠছে ও যাচ্ছে—এমন দৃশ্য গণমাধ্যমে দেখানো হচ্ছে। করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি অবশ্য ক্ষীণ কণ্ঠে কলকারখানা খুলে দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে।
যে সামাজিক দূরত্বের কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে আসছে, তা এসব ক্ষেত্রে বজায় থাকছে না। গতকাল শনিবারও নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেছেন, সংক্রমণ প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় উপায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে করোনাবিষয়ক অনেকগুলো নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা আছে। কিন্তু সেখানে সামাজিক দূরত্ব বিষয়ে কিছু নেই। অবশ্য তারা এখন এমন একটি নীতিমালা তৈরির কাজ করছে বলে জানা গেছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক দূরত্বের সর্বজনীন অর্থ বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। বহু মানুষ বস্তিতে বাস করেন, এক ঘরে ৮–১০ জন থাকেন। বেশ কিছু পরিবার এক রান্নাঘর, এক পানির কল, এক শৌচাগার ভাগাভাগি করে ব্যবহার করেন। তাঁদের কাছে সামাজিক দূরত্বের অর্থ কী? তাঁদের পক্ষে কি ৩ ফুটের দূরত্ব মেনে চলা সম্ভব, নাকি মানতে বলা বাস্তবসম্মত। একইভাবে কলকারখানা চালু করার সময়েও করণীয় বিষয়টি স্পষ্ট ছিল না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। অনেকেই বোঝেন না যে একজন সংক্রমিত ব্যক্তি পুরো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য কত বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারেন।
করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে। মানুষের শ্বাসতন্ত্রে এর সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি–কাশির সঙ্গে এই ভাইরাস বেরিয়ে আসে। এই ভাইরাসের চরিত্র সম্পর্কে স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা এখনো বিজ্ঞানী ও গবেষকদের হয়নি। তবে তাঁরা বলছেন, সংক্রমিত ব্যক্তি বা সন্দেহভাজন সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে ৩ ফুট দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। এটা নিরাপদ দূরত্ব। এই দূরত্ব পার হয়ে হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ভাইরাস অন্যের শরীর পর্যন্ত পৌঁছায় না। তবে হাঁচি–কাশি ছাড়াও কীভাবে ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তা নিয়ে গবেষণা শেষ হয়নি।
করোনা চিকিৎসায় এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। কার্যকর ওষুধ খুঁজে চলেছে বিশ্ব। কোনো টিকাও নেই। টিকা পেতে বিশ্ববাসীকে ৮ থেকে ১৮ মাস অপেক্ষা করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ শেষ হবে না। সংক্রমিত একজন থেকে অন্যজনে, তারপর তা বহুজনে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তাই থেকেই যাচ্ছে। কার্যকর ওষুধ বা টিকা পাওয়ার আগ পর্যন্ত ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধের উপায় হচ্ছে ‘সামাজিক দূরত্ব’। এটাকে কার্যকর করার জন্য ‘লকডাউন’ বা ‘শাটডাউন’কে উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে অনেক দেশ। বাংলাদেশও তা–ই করেছে। ২১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেশি, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান আরও দৃঢ় করার কথা বলেছিলেন।
এখন আর সামাজিক দূরত্বের কথা বলে খুব বেশি ফল পাওয়া যাবে না। এখন শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কলকারখানা–অফিস–আদালতে এবং জনপরিসরে (পাবলিক প্লেস)। বস্তির পরিবার, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল কী হবে, তা স্পষ্ট করতে হবে। কলকারখানা–অফিস–আদালত কীভাবে নিরাপদ রেখে চালু রাখা যাবে, তার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা তৈরি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। শিশুদের স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে বিদ্যা দান করবে, তা নিয়েও কাজ চলছে বিভিন্ন দেশে। স্টেডিয়ামে, বড় বিপণিবিতানে, পার্কে, রেলস্টেশনে বা অন্য কোনো জনসমাগমের স্থানে মানুষ কী আচরণ করবে, তা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। এগুলোর খোঁজ করা, পর্যালোচনা করা, নিজেদের মতো করে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। বিশেষজ্ঞরা এসব বিষয়ে কাজ শুরুর তাগিদ দিচ্ছেন। মেনে নিতে হবে যে ভাইরাসটি সহজে সমাজ থেকে যাচ্ছে না।