দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় অর্ধেকই (৪৯.১৯%) ৬০ বছরের কম বয়সী। আর ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ ষাটোর্ধ্ব। সংখ্যায় কম হলেও তরুণদের মৃত্যুর ঘটনাও আছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও চীনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, সেসব দেশে ষাটোর্ধ্ব মানুষ বেশি মারা যাচ্ছেন। তবে ওই সব দেশে মৃত ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশের বেশি ষাটোর্ধ্ব। ওই সব দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ৬০ বছরের কম বয়সী ব্যক্তিদের মৃত্যুর হার এখন পর্যন্ত বেশি। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির ফারাকের কারণে এই তারতম্য হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে প্রথম করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্তের খবর প্রকাশ পায় গত ৮ মার্চ। এর ১০ দিনের মাথায়, ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর খবর জানানো হয়। গতকাল সোমবার পর্যন্ত দেশে মোট ১০১ জন মারা গেছেন। আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ৯৪৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মৃত ব্যক্তিদের সবার বয়সের তথ্য প্রকাশ করেনি। গতকাল পর্যন্ত মারা যাওয়া ৬৩ জনের বয়সের তথ্য পাওয়া গেছে।
এই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৩২ জনের বয়স ৬১ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ ষাটোর্ধ্ব। ১৭ জনের (২৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ) বয়স ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। ১১ শতাংশ বা ৭ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী আছেন ৬ জন (৯ দশমিক ৫২ শতাংশ)। একজনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একটি বড় অংশের কোভিড-১৯-এর পাশাপাশি অন্য রোগ ছিল।
অন্য দেশের চিত্র
বিশ্বে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে চীনের উহানে। সম্প্রতি চীন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি যৌথ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, চীনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭৭ দশমিক ৮ শতাংশের বয়স ৩০ থেকে ৬৯ বছরের মধ্যে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশের বয়স ছিল ৬০-এর ওপরে। তাতে বলা হয়, ৬০ বছরের বেশি বয়সী এবং যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ ও দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ আছে, তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চীনে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী ছিলেন মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ আর ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ৫০ থেকে ৫৯ বছরের ছিল ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮০ শতাংশের বয়স ৬৫ থেকে এর ওপরে (সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার, ১৮ মার্চ)।
ইতালিতে ১৭ মার্চ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তিদের ৯৬ শতাংশের বয়স ছিল ৬০–এর বেশি। এর মধ্যে ৫২ শতাংশের বয়স ৮০ বছরের ওপরে। ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী ছিল শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকস দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ৫৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী পুরুষ এবং ৬৫ থেকে ৬৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এ ছাড়া মারা যাওয়া প্রতি ৫ জনের ১ জনের বয়স ৮০ বছরের ওপরে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত শনিবার বলেছে, তাদের দেশে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৭৫ শতাংশ ষাটোর্ধ্ব। (সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে)
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বিকেল চারটা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার ছিল ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে ১৩ দশমিক ৩, ইতালিতে ১৩ দশমিক ২, ফ্রান্সে ১২ দশমিক ৮০, স্পেনে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ এবং চীনে মৃত্যুর হার ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর হার ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ।
তরুণ-যুবকেরা বেশি আক্রান্ত
১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৪১ শতাংশের বয়স ২১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ছিল। সে ধারা অব্যাহত আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত রোববার শনাক্ত হওয়া ৩১২ জনের মধ্যে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশের বয়স ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর ২২ দশমিক ৩ শতাংশের বয়স ২১-৩১ বছরের মধ্যে। তার আগের দিন শনাক্ত হওয়াদের ২৭ শতাংশ ছিল ২১-৩০ বছরের। ২২ শতাংশ ছিল ৩১-৪০ বছর বয়সী। এই বয়সী মানুষের বাইরে চলাচল বেশি হওয়ায় সংক্রমণের হারও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।
কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কম বয়সী ব্যক্তিরা কেন বেশি সংখ্যায় মারা যাচ্ছেন, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়নি। তবে আইইডিসিআরের পরামর্শক ও রোগতত্ত্ববিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দেশভেদে স্বাস্থ্যের অবস্থা, পুষ্টির অবস্থা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভিন্ন রকম। তবে এখনো শেষ কথা বলার সময় আসেনি। তিনি বলেন, আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়ছে। শেষ পর্যায়ে গিয়ে চূড়ান্ত বিচার করা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯–এ কম বয়সী মানুষের মৃত্যুর হার বেশি।