দেশে এইচআইভি/এইডসে আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। নতুন রোগীদের একটি বড় অংশ অভিবাসী কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্য। আগে ঝুঁকিপূর্ণ চার ধরনের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন রোগী বেশি পাওয়া গেলেও এই বছর সাধারণ মানুষের মধ্যে সংক্রমণ বেড়েছে। এই তথ্য সরকারের।
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে ১০, ২০, ১০০ বা ২০০ জন করে নতুন রোগী প্রতিবছর শনাক্ত হয়েছে। ২০১৮ সালে নতুন রোগী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬৯ জনে। এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম এক রোগী মারা যায় ২০০০ সালে। ২০১৮ সালে একই রোগে মৃতের সংখ্যা ১৪৮। এ বছর নতুন আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। তবে মৃত্যু কিছু কমেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।
বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে আজ রোববার ২০১৯ সালের নতুন আক্রান্ত, মৃত ও অন্যান্য পরিসংখ্যান প্রকাশ করবে সরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে এইচআইভিতে আক্রান্ত নতুন রোগী এবং মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। আগে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে নতুন রোগী বেশি পাওয়া যেত। কিন্তু এ বছর সাধারণ মানুষের মধ্যে সংক্রমণ বেশি দেখা গেছে।’
জাতিসংঘের এইচআইভি/এইডসবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইডসের গত বছরের প্রাক্কলন বলছে, বাংলাদেশে এইচআইভিতে আক্রান্তদের অনুমিত সংখ্যা ১৩ হাজার। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পরীক্ষার মাধ্যমে ৬ হাজার ৪৫৫ জন শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্তের বাইরে থাকা মানুষ চিকিৎসাও নিচ্ছে না, অন্যদিকে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির কর্মকর্তারা বলছেন, এইচআইভি–আক্রান্তদের ৫০ শতাংশ জানেনই না যে তাঁদের এই রোগ হয়েছে। যাঁরা জানেন, তাঁদের এক–তৃতীয়াংশের বেশি চিকিৎসা নেন না। আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়মিত ওষুধ (অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল) সেবন করতে হয়, রক্ত পরীক্ষা করাতে হয়। তবে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের শারীরিক পরিস্থিতি কী, সেই তথ্য সরকারের কাছে নেই। এ বিষয়ে তথ্য সংরক্ষণের কাজ সবে শুরু করেছে সরকার।
>বিশ্ব এইডস দিবস আজ। নতুন রোগীদের একটা বড় অংশ অভিবাসী কর্মী ও তাঁর পরিবারের সদস্য। সাধারণ মানুষের মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে।
জাতীয় কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক সামিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার কম, মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। সংক্রমণের হার কম হলেও ঘনবসতি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন এবং অসচেতনতার কারণে এইচআইভির ঝুঁকি রয়েছে। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমারসহ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় এইচআইভি সংক্রমণের হার অনেক বেশি হওয়ায় বাংলাদেশের ঝুঁকি রয়েছে।
অভিবাসীর পরিবার ঝুঁকিতে
নতুন রোগীদের একটি বড় অংশ অভিবাসী কর্মী। তবে অভিবাসীদের পাশাপাশি তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও সংক্রমণের হার বেশি। ২০১৮ সালে এইচআইভিতে আক্রান্ত নতুন রোগীদের ৩০ শতাংশ ছিল অভিবাসী কর্মী বা তাঁর পরিবারের সদস্য।
নোয়াখালীর এক ব্যক্তি তিন বছর মালয়েশিয়াতে কাজ শেষে ২০১৭ সালে দেশে ফিরে আসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৮ সালে আত্মীয়কে রক্ত দিতে গিয়ে জানতে পারেন, তিনি এইচআইভিতে আক্রান্ত। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী স্ত্রীকে পরীক্ষার আওতায় নেওয়া হলে জানা যায়, স্ত্রীও আক্রান্ত। ৩৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তি বলেন, ‘এইচআইভির বিষয়ে আগে তেমন জানতাম না। সচেতনতাও ছিল না। নিজের চেয়ে স্ত্রী এই রোগে আক্রান্ত হওয়ায় বেশি খারাপ লাগছে।’
বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে থাকেন। তাঁদের একটি বড় অংশ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন মধ্যপ্রাচ্যে। এঁদের কেউ কেউবিদেশে ঝুঁকিপূর্ণ জীবন যাপন করেন। কয়েক বছর ধরেই দেখা গেছে, অভিবাসীদের কেউ কেউ এইচআইভি–আক্রান্ত হয়ে দেশে ফিরছেন।
মো. আখতারুজ্জামান বলেন, সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করা সম্ভব হলে অভিবাসীদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমবে।
যৌনকর্মীদের ঝুঁকি
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শিরায় মাদক গ্রহণকারী, নারী যৌনকর্মী, সমকামী/পুরুষ যৌনকর্মী এবং হিজড়া—এই চার ধরনের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি/এইডসের ঝুঁকি বেশি। ইউএনএইডসের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, সাধারণ মানুষের চেয়ে যৌনকর্মীদের এইচআইভি/এইডসের ঝুঁকি ২১ গুণ বেশি।
বাংলাদেশে এক লাখের বেশি নারী যৌনকর্মী আছে। তাদের মধ্যে কিশোরীদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। প্রয়োজনের সময় অনেকে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না।
যৌনকর্মীদের নিয়ে সরকারের এইচআইভি প্রতিরোধ কার্যক্রম অপ্রতুল উল্লেখ করে সেভ দ্য চিলড্রেনের এইচআইভি/এইডস কর্মসূচি ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়নের উপপরিচালক মির্জা মইনুল ইসলাম বলেন, যৌনকর্মীদের কাছে থেকে সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে কনডম ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
মাদকসেবীদের অবস্থা ভালো হচ্ছে
ঢাকা শহরের মাদকসেবীদের মধ্যে একসময় এইডসের সংক্রমণ খুব বেশি দেখা দেয়। শিরায় মাদকসেবীদের ২৭ শতাংশ এইচআইভি–আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতিকে ‘ঘনীভূত মহামারি’ বলেছিলেন। জাতীয় কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক সামিউল ইসলাম বলেন, ‘আক্রান্তের হার ১৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।’
তবে জাতীয় কর্মসূচি সঠিকভাবে চলছে না বলে মন্তব্য করেছেন ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কর্মসূচি সঠিক থাকলে বা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে শিরায় মাদকসেবীদের মধ্যে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকত। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে সংক্রমণের যে কথা শোনা যাচ্ছে, তা বড় ধরনের আশঙ্কার ইঙ্গিত দেয়।’